বাংলার কন্ঠস্বরঃ
বাঙালির কাছে ইলিশের গুণকীর্তন নতুন করে করার কিছু নেই। নতুন হলো, বৈশাখ বরণ উপলক্ষে চারপাশে যে সাজ সাজ রব, তার সঙ্গে ইলিশের যোগ। সে কারণেই মাস তিনেক হিমাগারে কাটিয়ে বাজারে আসা বরফচাপা ইলিশের দর এখন চৈত্রের খরতাপের চেয়েও চড়া। সাধারণ লোকের পক্ষে তার গায়ে হাত দেওয়া অসম্ভব।
এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার টাকায়। ওজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দাম। দুই কেজি ওজনের ইলিশ ঘরে আনতে হলে গুনতে হবে ন্যূনতম ছয় হাজার টাকা। তবে তেমন ক্রেতারও অভাব নেই। দরদাম যা-ই হোক, বাজার ঘুরে দেখা গেল, ইলিশ বিকোচ্ছে প্রচুর।
কারওয়ান বাজারে প্রধানত ইলিশ বিক্রি করেন এমন ব্যবসায়ী জনা দশেক। তাঁদের মধ্যে আছেন কামরুজ্জামান, মো. শিহাব, জিয়া উদ্দিন প্রমুখ। গতকাল শনিবার কামরুজ্জামান বললেন, মাপ অনুসারে এখন ইলিশের দর হলো প্রতিটি দুই কেজি ওজনের ছয় হাজার টাকা, দেড় কেজি সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার, এক কেজি ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০, পাঁচ শ থেকে আট শ গ্রাম আট শ থেকে এক হাজার টাকা। তবে শুরুতে ক্রেতার কাছে দাম হাঁকা হয় এর চেয়ে বেশি। দুই কেজি ওজনের ইলিশের দাম কেউ কেউ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হেঁকে বসেন।
এসব ইলিশ সদ্য নদী থেকে তুলে আনা, তা ভাবার কারণ নেই। আড়তদার কামরুজ্জামান বললেন, এ বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝ নাগাদ পদ্মা-মেঘনায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়েছিল। এসব ইলিশ সেই সময়ের। চাঁদপুরের হিমাগারে রাখা হয়েছিল। আবার বড় আড়তদারেরা নিজেরাই ঢাকায় এনে মজুত করেছেন। কামরুজ্জামান ফেব্রুয়ারিতে নিজে মজুত করেছিলেন ১০ টন ইলিশ। ইতিমধ্যে অর্ধেক বিক্রি শেষ। প্রতিদিন দুই শর বেশি ইলিশ বিক্রি করেছেন। বিক্রি নিয়ে বেশ সন্তুষ্ট তিনি। বললেন, ‘এখন ইলিশের মৌসুম না। তাই দাম একটু বেশি। হ্যার পরেও উৎসবের লাইগ্যা লোকে কিনতাছে।’
এই উৎসবের সঙ্গে ইলিশের যোগ কেমন করে ঘটল, সেই প্রশ্ন ছিল ফোকলোর বিশেষজ্ঞ বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের কাছে। তিনি বললেন, অতীতে পয়লা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশের কোনো সম্পর্কই ছিল না। এটি একেবারেই হাল আমলের হুজুগ। আগের দিনে পয়লা বৈশাখে যে উৎসব হতো, তার নাম ‘আমানি’। চৈত্রসংক্রান্তির বিকেলের মাটির পাত্রে পানি ভরিয়ে তার ভেতর আমপাতা দিয়ে রাখতেন কিষানিরা। পরদিন সেই পানি ছিটিয়ে দেওয়া হতো ঘরবাড়িতে। রাতে ঢেঁকি-ছাঁটা মোটা চালের ভাতে পানি দিয়ে পান্তা করে রাখা হতো। পরের দিনে সেই পান্তা কিছুটা গেঁজে যেত। ওই পান্তার সঙ্গে থাকত পেঁয়াজ আর মরিচপোড়া। বড়জোর আলুভর্তা। এই হলো খাবার। শামসুজ্জামান খান বললেন, গত শতকের আশির দশক থেকে এখানে অনেক বড় একটি শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে। তারাই এখন গ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উৎসবকে নতুন করে তাদের জীবনযাত্রার উপযোগী করে শহরে তুলে আনছেন। শহুরে লোক এখন শখ করে গরম ভাতে পানি দিয়ে পান্তা তৈরি করে। তার সঙ্গে যোগ করেছে ইলিশ ভাজা।
ইলিশ বিশেষজ্ঞ চাঁদপুরের মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বললেন, এখন জাটকা ইলিশের বড় হওয়ার মৌসুম। গত ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ। এ ছাড়া প্রধান প্রজনন মৌসুম সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেও (আশ্বিনের পূর্ণিমা অনুসারে) ১৫ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে। জাটকা ধরা বন্ধ রাখতে অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে। পুরোপুরি বন্ধ না হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এতে ইলিশের উৎপাদনও বেড়েছে। ২০০৯ সালে বার্ষিক উৎপাদন ছিল প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন। এখন ৩ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন।
প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করেছেন চাঁদপুর প্রতিনিধি আলম পলাশ।