বাংলার কন্ঠস্বরঃ
গেল ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে আধুনিক বাংলা অভিধান। এটি কেন আধুনিক? বাজারে এত অভিধান থাকতে এর প্রয়োজন ও বিশেষত্বই-বা কোথায়? এসব নানা প্রসঙ্গে প্রথম আলোর মুখোমুখি হয়েছেন এই অভিধানের সম্পাদক জামিল চৌধুরী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারিক মনজুর
তারিক মনজুর: আধুনিক বাংলা অভিধানের বিশেষত্ব কোথায়? কিংবা এটাকে আমরা ‘আধুনিক’ বলব কেন?
জামিল চৌধুরী: কিছু শব্দ আমি দিয়েছি, যেগুলো বাজারের প্রচলিত অভিধানে নেই—কিন্তু থাকা দরকার। এই শব্দগুলো আমাদেরই হয়ে গেছে; যেমন: সেলফি, সিমকার্ড—এগুলো বাদ দিয়ে তো আমরা চলতে পারি না।
তারিক: নতুন শব্দ-সংযোজন করেছেন। আর?
জামিল: বাংলা অভিধান-এ দেখবেন কিছু প্রতিশব্দ দেওয়া থাকে। কিন্তু এখানে আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। আপনাকে দুটি শব্দ দেখাই…এখানে দেখুন ‘আগুন’—‘নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে কোনো পদার্থের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট তাপ ও আলো বিকিরণকারী শিখা’। আমরা যদি ‘অনল’ বলি, তাহলে তো আগুনের প্রকৃত পরিচয় হবে না।
তারিক: তাহলে প্রতিশব্দ যথাসম্ভব বর্জন করেছেন?
জামিল: বর্জন করা সম্ভব না। আবার দেখুন ‘মাছরাঙা’। আমরা কি বলব ‘পাখিবিশেষ’? এটাকে আমরা লিখেছি, ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জলাশয়ের ওপর নিশ্চল হয়ে শূন্যে ভেসে থেকে শিকারের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার পর জলে ঝাঁপ দিয়ে শিকার তুলে আনে, এমন বড় মাথাওয়ালা বিচিত্র বর্ণের উজ্জ্বল পালকবিশিষ্ট পাখি’।
তারিক: প্রথমে বললেন শব্দ-সংযোজনের কথা, তারপর বললেন সংজ্ঞার্থ দেওয়ার ব্যাপারটা। আর কোনো বিশেষত্ব?
জামিল: আরেকটা জিনিস দেখুন, আমরা এত দিন ধরে বাংলা যে বর্ণ ব্যবহার করে এসেছি, তাতে যুক্তবর্ণ অদ্ভুত আকার পায়। এই শব্দটা দেখুন—ল-য়ে ল, সঙ্গে হ্রস্ব উ-কার। যেটা সবাই ব্যবহার করে—একটার সঙ্গে অন্যটা লেগে যায়, অনেক ঝুলে যায়, উচ্চতা বেড়ে যায়। অন্য যুক্তাক্ষরগুলোও দেখুন খুব পরিষ্কার।
তারপর আরেকটা জিনিস আমাদের নজর দেওয়ার সময় এসেছে। আমরা এত দিন ধরে কয়েকটা বর্ণের অবস্থান ভুল দেখে এসেছি। যেমন: ‘চন্দ্রবিন্দু’ স্বরের ওপরে হওয়া উচিত।
তারিক: আপনার আগের বানান অভিধান—যেটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত, সেখানে কিন্তু ব্যঞ্জনের ওপরে চন্দ্রবিন্দু বসেছে।
জামিল: আমি তখন এই বিষয়গুলো দেখিনি। আমরা এখানে ডেফিনেশনেই বলেছি, ‘চন্দ্রবিন্দু’ অনুনাসিক ধ্বনির প্রতীকরূপে কেবল স্বরবর্ণ বা স্বরের সঙ্গে যুক্ত হয় এমন বর্ণ। তার সঙ্গে স্বর যুক্ত না হলে আপনি কিন্তু উচ্চারণই করতে পারবেন না। ঠিক তেমনি রেফ-এর অবস্থানও কিন্তু আমরা ভুল করি। এই অভিধানেও অবশ্য ভুল আছে। আমরা দ্বিতীয় সংস্করণে ঠিক করে ফেলেছি। আগে তো আমরা ‘র’ উচ্চারণ করি; তারপর বর্ণটা। আমরা যদি বলি ‘তর্ক’—ত, র, ক। রেফটা আমরা একটু বাঁদিকে সরিয়েছি। আর চন্দ্রবিন্দুটা একটু ডানদিকে রেখেছি।
তারিক: এই অভিধানের ফন্টের ব্যাপারে তাহলে বেশ ভেবেছেন।
জামিল: এটা প্রথম বাংলা ফন্ট। ১৯৮৪ সালে আমি যখন জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে ছিলাম, তখন এই বাংলা ফন্ট তৈরি করি। তখন বাংলাদেশে এভাবে কম্পিউটার ব্যবহার আরম্ভ হয়নি। এটা যিনি তৈরি করেছিলেন তিনি ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় পারেননি। এই ফন্ট দেখুন, কত স্বচ্ছ এবং কত পরিষ্কার। যেমন: আমরা ল্-য়ে ম লিখব, সঙ্গে সঙ্গে এটি নিচে নেমে আসবে। ল্-এর সঙ্গে ক—শুল্ক, কিংবা ক্ষ-এর সঙ্গে ম, যেমন—লক্ষ্মী কত পরিষ্কার। বর্ণগুলো ঝুলেছে কোথাও? অথচ এটি অনেক পুরান ফন্ট।
তারিক: এই ফন্টের নাম কী?
জামিল: শহিদ লিপি।
তারিক: ফন্টটি কে বানিয়েছিলেন?
জামিল: সাইফুদ্দাহার শহীদ নামে এক প্রকৌশলী। কিন্তু এটা প্রচার পায়নি। তিনি এখন আমেরিকায় থাকেন। আমি তাঁর কাছে বলেছিলাম একটা ফন্ট তৈরি করে দিতে। আমি এখন ভাবছি, বাংলা একাডেমিকে বলব কিছু টাকা খরচ করে এই ফন্ট সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে।
তারিক: এই ফন্ট তো বলছেন অনেক পুরান। তাহলে বিন্দুযুক্ত বর্ণ যেমন: জ-এর নিচে বিন্দু, ফ-এর নিচে বিন্দু দেওয়া বর্ণগুলো কি নতুন বানানো?
জামিল: এগুলো তো আমরা নতুন দিতে শুরু করেছি। আমি অবশ্য এটা আমার আগের অভিধানে ব্যবহার করেছি। কলকাতার দে’জ থেকে আমার একটা অভিধান বেরিয়েছে—শব্দ সংকেত। সেখানে কিন্তু আছে এটা।
তারিক: দে’জ থেকে প্রকাশিত আপনার শব্দ সংকেত (২০০৯) অভিধানে আন্তর্জাতিক ধ্বনিতাত্ত্বিক বর্ণমালা বা আইপিএ ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে সেটা করতে চাইলেন না কেন?
জামিল: ওখানে যে আইপিএ ব্যবহার করা হয়েছে সেটা পুরান ফন্ট। নতুন ফন্ট আমার কাছে ছিল না। হয়তো দেওয়া যেত, কিন্তু তখন কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
তারিক: আপনার নতুন অভিধানে সম্পাদনা সহযোগীদের ভূমিকা কী ছিল?
জামিল: তাঁদের বলা হয়েছিল বিভিন্ন জায়গা থেকে লিখে আনতে, ব্রিটানিকায় বা অন্য অভিধানে কী আছে তা দেখতে। এই অভিধানে আমরা কিন্তু ‘গাছবিশেষ’ বা ‘ফুলবিশেষ’ লিখে ছেড়ে দিইনি। যত দূর সম্ভব সেই গাছের বা ফুলের তথ্য সংগ্রহ করেছি—কোথায় হয়,