অথচ গত নভেম্বরে যখন গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয়েছিলো, তখন এই রুটের ভাড়ার তালিকায় দূরত্ব লেখা ছিলো ৪৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার। তখন ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১০৭ টাকা। ৯ মাসের ব্যবধানে একই রুটের দূরত্ব কীভাবে ৬ কিলোমিটার বাড়লো তা নিয়ে যাত্রীরা প্রশ্ন তুলেছেন।
একইভাবে আগের তালিকা অনুযায়ী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফুলবাড়িয়ার দূরত্ব ছিলো দুই কিলোমিটার। এছাড়া পল্টন ৩ দশমিক ১ কিলোমিটার, মহাখালী ৮ দশমিক ৮ কিলোমিটার, কাকলী ১০ দশমিক ৬ কিলোমিটার, বিমানবন্দর ১৮ দশমিক ১ কিলোমিটার দূরত্ব ছিলো। এখন নতুন তালিকা অনুযায়ী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহাখালীর দূরত্বই ১১ দশমিক ২ কিলোমিটার। বিমানবন্দরের দূরত্ব বলা হয়েছে ২০ দশমিক ৮ কিলোমিটার। দূরত্ব বেশি দেখানোর কারণে এই রুটের ভাড়াও বেড়েছে।
এদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, রাজধানীতে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের অফিস যাতায়াতে ভাড়া দুই হাজার ১০০ থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তেলের দাম ও গাড়ি ভাড়া বাড়ানোর পর অফিসগামী যাত্রীদের ওপর গবেষণা করে এ তথ্য পাওয়া যায়।
যাত্রীদের অভিযোগ, বাসস্ট্যান্ড একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব বাড়িয়ে ভাড়া নির্ধারণ করেছে বিআরটিএ। এর মাধ্যমে বাস মালিকদের অবৈধ সুবিধা দিচ্ছে সংস্থাটি। এতে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। এ নিয়ে প্রায়ই বাসে যাত্রীদের সঙ্গে বাসচালক এবং সহকারীদের বাগবিতণ্ডা হচ্ছে। অবিলম্বে এই রুটের দূরত্ব সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন তারা।
বিআরটিএ’র ভাড়া তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত নভেম্বরে গণপরিবহনে প্রতি কিলোমিটার দূরত্বে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিলো ২ দশমিক ১৫ টাকা। এখন নতুন তালিকা অনুযায়ী রাজধানীতে প্রতি কিলোমিটার বাসভাড়া ২ দশমিক ৫০ টাকা। এই হিসাবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চন্দ্রার ওই ৬ কিলোমিটার দূরত্বের বাস ভাড়া ১৫ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। এই রুটের অন্যান্য দূরত্বেও একইভাবে ভাড়া বেশি নেয়া হচ্ছে।
বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত আজমেরী পরিবহন চলাচল করে। এছাড়া এই রুটে গাজীপুর পর্যন্ত চলাচল করে ভিক্টর পরিবহন। এছাড়া গুলিস্তান, মতিঝিল থেকে আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানির বাস চন্দ্রা ও গাজীপুরে যাতায়াত করে।
চন্দ্রা থেকে আজমেরী পরিবহনে করে ব্যবসার কাজে প্রায়ই পুরান ঢাকার বাংলাবাজারে যাতায়াত করেন মোহাম্মদ হোসেন। তিনি বলেন, এবার অস্বাভাবিক হারে ভাড়া বেড়েছে। এই ভাড়া নিয়ে বাসচালকের সহকারী এবং যাত্রীদের মধ্যে প্রায়ই বাগবিতণ্ডা হচ্ছে। সব যাত্রীই বলছেন, দূরত্ব অনুযায়ী বাস ভাড়া বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চন্দ্রার দূরত্ব আগের তালিকা থেকে ৬ কিলোমিটার বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। এই বিষয়টি জানেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হোসেন বলেন, যদি এমনটা হয়, সেটা বিআরটিএ’র অন্যায় হয়েছে। তারা হয়তো বাস মালিকদের সুবিধা দিতে এমনটি করেছে। এসময় সঠিকভাবে দূরত্ব মেপে ভাড়া নির্ধারণের দাবি জানান তিনি।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গণপরিবহনের অতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধি এবং কিলোমিটার মাপে ভুল নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা। এ নিয়ে এক ব্যাক্তি ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেন, ধুপখোলা থেকে শাহবাগ ৬ কিলোমিটার হবে? মালঞ্চ বাসের ভাড়া ২৫ টাকা! এটা কোন দেশের আইন?
এর আগে গত ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে নতুন করে বাস ভাড়া মূল্যায়নের তালিকায় স্বাক্ষর করেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বিআরটিএ অধিশাখার উপ-সচিব মো. মনিরুল আলম। বুধবার বিকেলে এই বিষয়ে জানতে চাইলে মুঠোফোনে তিনি বলেন, আমরা মন্ত্রণালয় থেকে কিলোমিটার অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছি। এখন কিলোমিটার মেপে ভাড়া তালিকা করার দায়িত্ব বিআরটিএ’র।
এরপর এ বিষয়ে কথা বলতে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হয়। তবে তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যারা কর্মজীবী-শ্রমজীবী আছেন, তাদের প্রায় ৮০ শতাংশের বেতনে যাতায়াত ভাড়া দেয়া হয় না। আমরা বেশকিছু চাকরিজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। যারা বেতন পান সর্বনিম্ন তিন হাজার ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আমরা দু‘দিনে ২৮টি বাস কাউন্টারে পর্যবেক্ষণ করেছি। অফিসগামীদের প্রতিদিন যাতায়াতে বাস ভাড়া সর্বনিম্ন ৭০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যার পরিমাণ দুই হাজার ১০০ থেকে ছয় হাজার। যার বেতন তিন হাজার ২০০ টাকা, তিনি দুই হাজার ১০০ টাকা ভাড়া দেবেন কীভাবে?
তিনি আরও বলেন, একজন চাকরিজীবীর সঙ্গে আমি কথা বললাম, যিনি বেতন পান ১০ হাজার টাকা। দোকানে চাকরি করেন। তার স্ত্রীও চাকরি করেন। ঢাকায় সাবলেট থাকতেন। কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি গ্রামে চলে যাবেন। কারণ তার প্রতিদিন ৭০ টাকা গাড়ি ভাড়া ধরে মাসে দুই হাজার ১০০ টাকা ভাড়া বেড়েছে। এছাড়া মাসে চারবার বাড়িতে যান এমন অনেক চাকরিজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের চারবারের যাতায়াতে অনেকের এক হাজার আবার অনেকের চার হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া বেড়েছে।
রাজধানীর বাস ভাড়া বাড়তি রাখা হচ্ছে জানিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি বলেন, আমরা দু’দিনে ২৮টি বাস কাউন্টারে পর্যবেক্ষণ করেছি। সরকার বাড়িয়েছে আড়াই টাকা। কিন্তু সিটিতে প্রতি কিলোতে ৩ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র তার মানুষকে সব ধরনের সুযোগ দেবে। কিন্তু রাষ্ট্রের অসহযোগিতার কারণে মানুষের ওপর যে চাপটা তৈরি হয়, যে অর্থনৈতিক ধাক্কাটা পান, তাদের ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণা নেই। সরকার বাড়ালো জ্বালানি তেলের দাম। কিন্তু বেড়েছে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া। আমি জানতে চাইলাম একজন সিএনজিচালকের কাছে ভাড়া কেন বাড়াচ্ছেন, তিনি বলেন- চালের দাম বাড়ছে। আমাদের তো বাড়াতেই হবে। একজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, তিনি ২০ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, আগে আমার ৮০০ টাকা ইনকাম হলেও সংসার চালাতে পারতাম। এখন খরচ বেড়েছে।
যেহেতু এসব বিষয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। এজন্য সরকারের বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন মোজাম্মেল হক।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক, জ্বালানি বিশেষ ও বুয়েটের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক ডিন ড. ইজাজ হোসেন, সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান।
এদিকে পুননির্ধারিত বাস ভাড়া আদায়ে কয়েকটি বিষয় মানতে হবে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
বুধবার ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক সোমদানী খন্দকারের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিআরটিএ’র পুননির্ধারিত বাস ভাড়া কার্যকর করাসহ সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা করার জন্য ৮ আগস্ট বিকেলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ।
সভায় ঢাকার প্রায় ১২০টি পরিবহন কোম্পানির চেয়ারম্যান ও এমডি এবং সব রুট মালিক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সিদ্ধান্তগুলো হলো- ১. বিআরটিএ’র চার্ট অনুযায়ী ভাড়া আদায় করতে হবে- চার্টের বাইরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা যাবে না। প্রতিটি গাড়িতে দৃশ্যমান স্থানে ভাড়ার চার্ট অবশ্যই টানিয়ে রাখতে হবে।
২. কোনো পরিবহনের গাড়িতে বিআরটিএ’র পুননির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া যাতে আদায় না করা হয়, সে বিষয়ে সভায় মালিকদের সমন্বয়ে ৯টি ভিজিলেন্স টিম গঠন করা হয়। এসব টিম বিআরটিএ’র ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে থেকে সব অনিয়ম তদারকিসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে।
৩. ঢাকা শহর ও শহরতলী রুটে চলাচলকারী গাড়ির ওয়েবিলে কোনো স্ল্যাব থাকবে না। রাস্তায় কোনো চেকার থাকবে না। এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজ পর্যন্ত গাড়ির দরজা বন্ধ থাকবে, খোলা রাখা যাবে না। রুট পারমিটের স্টপেজ অনুযায়ী গাড়ি থামাতে হবে।
এ সিদ্ধান্ত ১০ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ভিজিল্যান্স টিমের কার্যক্রম চলমান থাকবে বলেও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এর আগে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে বাস মালিকদের দাবির মুখে বাস ভাড়া বাড়ায় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ৭ আগস্ট থেকে নতুন এ ভাড়া কার্যকর হয়।
বিআরটিএ’র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দুরপাল্লার বাসে প্রতি কিলোমিটারের জন্য যাত্রীপ্রতি ভাড়া ৪০ পয়সা বাড়িয়ে ২ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। আর মহানগরে প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৩৫ পয়সা বাড়িয়ে ২ টাকা ৫০ পয়সা ঠিক করা হয়। এছাড়া বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ১০ টাকা আর মিনিবাসে ৮ টাকা।
Leave a Reply