প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মুক্তির সংগ্রামে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা একে একে সবাই চলে যাচ্ছেন। নতুন যাঁরা আছেন, তাঁরা এঁদের অনুসরণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নেবেন। আমাদের সময় হলে চলে যেতে হবে। কিন্তু দেশ নিয়ে কেউ যাতে ছিনিমিনি খেলতে না পারে, নতুনদের মধ্যে সে চেষ্টা থাকতে হবে।
প্রয়াত সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে আজ রোববার সংসদে উত্থাপিত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। এরপর সর্বসম্মত শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। শোক প্রস্তাব গ্রহণ শেষে রেওয়াজ অনুযায়ী সংসদের অধিবেশন মুলতবি করা হয়।
আলোচনায় শেখ হাসিনা বলেন, মানুষ চলে যায়। কিন্তু তাঁর কীর্তি ও কথা থেকে যায়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সে রকমই একজন। অনেক কঠিন কথাকে হাস্যরস দিয়ে সহজ করে তুলে ধরা, মানুষকে আকর্ষণ করার অসাধারণ ক্ষমতা তাঁর মধ্যে ছিল। গত বৃহস্পতিবার এই সংসদে তিনি শেষ বক্তৃতা দিয়ে যান। তাঁর সে কথাগুলোও মনে থেকে যাবে সবার।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘নতুনদের বলব, সময় হলে আমাদের চলে যেতে হবে। আমাদের বয়স হয়ে যাচ্ছে, চলে যেতে হবে। তাই দেশটাকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নতুনদের নিতে হবে।’
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাজনীতি ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই সংসদে যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন, একে একে তাঁদের হারাতে হচ্ছে। সত্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এখন হাতেগোনা কয়েকজন আছেন। আমার জন্য এটা সত্যিই কষ্টদায়ক। অনেক সংগ্রামের পথ হেঁটে আমরা গণতন্ত্রকে একটা জায়গায় দাঁড় করাতে পেরেছি। সংগ্রামের পথে একজন সাথি ছিলেন সুরঞ্জিত।’
এরশাদের শাসনামলের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরশাদ সরকারের সময় সেনাবাহিনী তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। সেই সময় তাঁর ৯/১০ বছরের ছেলে ভয়ে চিৎকার দিয়ে উঠেছিল। হারিয়ে ফেলেছিল মানসিক ভারসাম্য। পরে কানাডায় নিয়ে দীর্ঘ চিকিৎসার পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২১ আগস্টের ঘটনায় স্প্লিন্টারের আঘাতে আমাদের অনেকেই আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে সুরঞ্জিত সেনও ছিলেন।’
সংবিধান প্রণয়নের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের প্রথম সংবিধার রচনা কমিটির সদস্য ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। ওই সময় অনেক কথাবার্তা-তর্কবিতর্ক হতো। তখনকার সময়ে কথা বলার কেউ ছিল না। বলতে গেলে সুরঞ্জিত সেন একাই এক শ ছিলেন। এ জন্য বঙ্গবন্ধু তাঁকে উৎসাহিত করতেন। বেশি বেশি কথা বলার সুযোগ দিতেন। এভাবে বলতে দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন।’
বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুতে যে শূন্যতা হয়েছে, তাঁর মৃত্যুতে সংসদের যে জায়গাটি খালি হয়েছে, সেটা কখনো পূরণ হবে কি না, জানি না।’ তিনি বলেন, ‘কেউ চলে গেলে আমরা তাঁর মূল্যায়ন করি, বেঁচে থাকতে করি না। কিছু কিছু মৃত্যু আছে পাখির পালকের মতো হালকা। একেবারে বাতাসের সাথে উড়ে যায়। আর কিছু কিছু মৃত্যু আছে পাহাড়ের মতো ভারী। একেবারে জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের বুকে চেপে ধরে। সুরঞ্জিত সেনের মৃত্যুর বিষয়টি ঠিক এ রকমই আমাদের বুকে চেপে ধরেছে।’
সংসদের ডেপুটি স্পিকার বলেন, ‘১৯৮৬ সালের সংসদে সুরঞ্জিত সেনের একটি বক্তৃতা শুনে আমি নবাগত হিসেবে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। এরপর প্রায়ই তাঁর কাছে ছুটে যেতাম কীভাবে সংসদে ভালো বক্তৃতা দেওয়া যায়। তিনি যেসব পরামর্শ দিয়েছিলেন আজও সেটা পালনের চেষ্টা করি।’
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, ‘সংসদে ও সংসদের বাইরে সুরঞ্জিত ছিলেন সংবিধান ও গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা। তিনি ৭২-এর সংবিধানের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন।’
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। তাঁকে “কেমন আছেন” জানতে চাইলে তিনি শরীরের কথা বাদ দিয়ে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেন।’
শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ‘৪৭ বছর সংসদে ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সংসদে দেওয়া তাঁর বক্তৃতা শুনলে বোঝা যায় তিনি কত বড় পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘সুরঞ্জিত ট্র্যাজিক হিরো। তাঁকে সরকারি দলে মানাত না। তাঁকে বিরোধী দলেই বেশি মানাত। তিনি যে কত বড় পার্লামেন্টারিয়ান, সেটা আমরা ৮৬ সালে দেখেছি।’
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘মঞ্চে ও সংসদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মতো বাগ্মী বিরল। তিনি ছিলেন জগন্নাথ হলের অপরিহার্য নাট্য অভিনেতা। তাঁর অনেক গুণের মধ্যে এটি অপ্রকাশিত ছিল। তাঁর এলাকায় তিনি ছিলেন হ্যামিলনের বংশীবাদক।’
শোক প্রস্তাবের ওপর আরও আলোচনা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, হুইপ মো. শাহাবুদ্দীনসহ শওকত আলী, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, আব্দুর রাজ্জাক, আবদুল মতিন খসরু, আবদুস শহীদ, আলী আশরাফ, মৃণাল কান্তি দাস, মুহিবুর রহমান মানিক, আবদুল মজিদ খান, শেখ ফজলে নূর, আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, জাতীয় পার্টির জিয়াউল হক মৃধা, জিয়া উদ্দিন আহমেদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, পীর ফজলুর রহমান, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল ও স্বতন্ত্র সাংসদ রুস্তম আলী ফরাজী।