এস.এম. সাইফুল ইসলাম কবির, সুন্দরবন থেকে ফিরে // দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মৎস্যভান্ডার নামে খ্যাতবিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে উপকূলে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন।অপার প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সুন্দরবন যারা দেখেননি তারা ছুটিতে বেড়িয়ে যেতে পারেন এই সুন্দরী ম্যানগ্রোভ বন।নদীর স্রোত কেটে নৌকা এগোচ্ছে, চারপাশে ছমছমে সবুজ! পানির ধারে দাঁড়িয়ে আছে ম্যানগ্রোভ গাছের জটিল শেকড়। হঠাৎ কোথাও বানরের হুল্লোড়, কোথাও হরিণের নীরব পদচারণা। কোথাও লোনা পানির কুমিরের ধীরগতির সাঁতার। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসে গভীর গর্জন! হ্যাঁ, সেটা বাঘের। ঠিক ধরেছেন। স্বাগতম, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবনে।
প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের সুন্দরবনের প্রায় ৬,৫১৭ বর্গকিলোমিটার পড়েছে আমাদের দেশে। যা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলাকে আচ্ছাদিত করেছে। বনটি ইউনেস্কো ১৯৮৭ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শুধু গাছপালা নয়, এখানকার প্রাণী, মানুষ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের অনন্য সমন্বয় সুন্দরবনকে করে তুলেছে আমাদের দেশের অমূল্য সম্পদ।
সুন্দরবনে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের গাছ। যেমন সুন্দরী, গরান, কেওড়া ও গোলপাতা অন্যতম। গাছগুলো লবণাক্ত মাটিকে ধরে রাখে এবং জলবায়ুর প্রতিকূল প্রভাব থেকে উপকূলবর্তী মানুষকে রক্ষা করে। এ বন কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়; প্রাকৃতিক সুরক্ষার জন্যও ঢাল হয়ে কাজ করে।
সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বন বিভাগের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাঘের সংখ্যা বাংলাদেশ অংশে ১২৫টি। এ ছাড়া রয়েছে স্পটেড ডিয়ার, বন্যশূকর, ম্যানগ্রোভ ওটার, লোনা পানির কুমির, ফিশিং ক্যাট, অজগর এবং আরও অসংখ্য প্রাণীর সমাহার। প্রতিটি ভ্রমণকারীর আশা থাকে এই প্রাণীর প্রকৃত পরিবেশে দেখা পাওয়ার।
সুন্দরবনের সৌন্দর্য পুরোপুরি উপলব্ধি করতে হলে নৌকা ভ্রমণ অপরিহার্য। সরু খাল ও বিস্তৃত নদীর মধ্যে ভেসে চলা নৌকা যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্ম। অনেক সময় খালের ভেতরে ঢুকে গেলে প্রকৃতির সবুজের মাঝে চলে আসা যায় একেবারে কাছাকাছি। ছোট ছোট ডিঙি নৌকা বা ট্রলার ব্যবহার করে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সত্যিই মনোমুগ্ধকর।বাংলাদেশ অংশের ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই বনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থান হলো পূর্ব বনবিভাগের বাগেরহাটের শরণখোলা রেঞ্জ।
দু’ধারে ঘন জঙ্গলের মাঝ থেকে বয়ে চলা এখানকা আকাবাঁকা নদী-খাল আর বন্যপ্রাণির অবাধ বিচরণ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সব সময়ই আকৃষ্ট করে। তাই তারা দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ছুঁটে আসেন এখানে।
শরণখোলার এই বনের কটকা, কচিখালী, সুপতি, দুবলা, আলোরকোল, কোকিলমণি, টিয়ারচরসহ আছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। শরণখোলা থেকে সহজ পথে খুব কম খরচে ও অল্প সময়ে এসব দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসা যায়।
অথচ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাবে ও প্রচার-প্রচারণা না থাকায় পর্যটন শিল্প বিকাশের এই অপার সম্ভাবনাময় খাতটি পেছনে পড়ে আছে।
সুন্দরবন ভ্রমণের এই সহজ রুট সম্পর্কে ব্যাপক পরিচিতি না থাকায় পর্যটকরা অধিক সময় ও অর্থ খরচ করে খুলনা ও মোংলা রুট দিয়ে শরণখোলার বনে প্রবেশ করে। শরণখোলা রেঞ্জের আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থানসমূহ সম্পর্কে জেনে নিন-
কটকা
সুন্দরবনের আকর্ষণীয় সব স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি স্পট হলো শরণখোলা রেঞ্জের কটকা বনাঞ্চল। বন্য জীবজন্তু, মৎস্য ও জলজ প্রাণীর প্রজননের জন্য এটি অভযারণ্য হিসেবে ঘোষিত। এখানকার জামতলায় আছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। টাওয়ার থেকে দেখা যায়, বনের উপরিভাগের বিশাল সবুজ ঘন জঙ্গল।
ভাগ্য প্রসন্ন হলে দেখা মিলতে পারে রাজকীয় ভঙ্গিতে ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গলের শরীর দুলিয়ে হেঁটে চলা। জামতলার পাশেই আছে বিশাল সি বিচ। এই বিচেই আছড়ে পড়ে বঙ্গোপসাগরের বড় বড় ঢেউ। যেখানে একই সঙ্গে উপভোগ করা যায় কক্সবাজার ও কুয়াকাটা সৈকতের আনন্দ আর সুন্দরবনের সৌন্দর্য।
কটকা বনঅফিসের আশপাশে মায়াবি চিত্রল হরিণের অবাধ বিচরণ, বানরে ছুঁটোছুঁটি সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবে। অফিসের পেছনে আছে প্রায় ২০০ মিটার দীর্ঘ একটি ফুটট্রেইল। ট্রেইলের মাথায় গেলেই খুব কাছ থেকে দেখা যাবে হরিণের মেলা।
ইচ্ছে করলে হরিণের সঙ্গে সেলফিও তোলা সম্ভব। পর্যটকদের রাত্রিযাপনের জন্য বনবিভাগের একটি রেস্টহাউজও আছে। যেখানে নিরাপদে থাকার সুব্যবস্থাও পাবেন। তবে থাকতে হলে বনবিভাগের পূর্ব অনুমোতি নিতে হবে।
কচিখালী
কটকার মতো কচিখালীতেও আছে একটি রেস্টহাউজ। এই রেস্টহাউজে বসেই উপভোগ করা যায় সাগরের ঢেউয়ের মূর্ছনা, বণ্য পাখপাখালির কোলাহল, হরিণ-বানরের সখ্যতা।
বিজ্ঞাপন
সেখানে আরও আছে বিশাল সনের (সন ঘাস) বাগান। ঘন ঘাষে বাতাস হৃদয় জুড়ানো ঢেউ খেলে যায়। এই সন বাগান বাঘ, হরিণসহ বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। এখানেও আছে বিশাল সি বিচ।
সুপতি
এটিও অভয়ারণ্য এলাকা। এখানের নদীতে দুর্লভ প্রজাতির ইরাবতী ডলফিনের দেখা মেলে। ছোট ছোট খালের দুই পাশে সারিবদ্ধ গোলপাতার বন পর্যকদের আকৃষ্ট করে। নিরাপত্তার জন্য বনবিভাগ ও কোস্টগার্ডের ক্যাম্প রয়েছে। এখানকার সৌন্দর্য উপভোগ করে দিনে দিনে ফিরে আসা যায়।
দুবলা ও আলোর কোল
শুঁটকি পল্লীর জন্য বিখ্যাত এই স্থান। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা দুবলার জেলে পল্লীর অধীনে ছোট-বড় ৮টি চরেই শুঁটকি উৎপাদন হয়। প্রতিবছর অক্টোবর-মার্চ এই ৫ মাস চলে শুঁটকি প্রক্রিয়ার কাজ।
প্রতিবছর রাস পূর্ণিমায় আলোরকোলে জমে ওঠে রাস উৎসব। এ উৎসবে দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটে। এখানকার বিশাল সি-বিচ থেকে সূর্য ওঠা ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। অসংখ্য গাঙচিলের কলকাকলিতে সারাক্ষণ মূখর থাকে পরিবেশ।
আর যেতে যেতে দেখা মিলবে সাগরে অসংখ্য জেলি ফিশের। দুবলাতে বনবিভাগের পাশাপাশি র্যাব ও কোস্টগার্ডের ক্যাম্প আছে। ওখানে রাত্রিযাপন করতে হলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে।
কোকিলমণি ও টিয়ারচর
এই স্থান দুটি হলো সুন্দরবনের সবচেয়ে গভীরতম স্থান। বন্যপ্রাণির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। কোকিলমণিতে আছে স্বচ্ছ ও মিষ্টি পানির এক বিশাল দীঘি। নোনা পানি বিধৌত এ সুন্দরবনের মধ্যে মিষ্টি পানিতে পর্যটকরা ইচ্ছে করলে অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করার জন্য গোসল সেরে নিতে পারেন।
এখানে নিরাপত্তার জন্য বনবিভাগ ও কোস্টগার্ডে অফিস রয়েছে। টিয়ারচরের হরিণের অবাধ বিচরণ দেখা যায়। এছাড়া বনমোরগ, শুকর, গুঁইসাপ, মদনটাক, বাজপাখিসহ অসংখ্য সরিসৃপের দেখা মেলে।
সুন্দরবন ভ্রমণে কীভাবে যাবেন?
শরণখোলায় আসতে হলে প্রথমে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে আসতে হবে। সেখান থেকে বিভিন্ন কোম্পানির বিলাশবহুল সব বাস আছে। এসব পরিবহনে টিকিট কেটে সরাসরি শরণখোলা উপজেলা সদর রায়েন্দায় পৌঁছানো যায়।
চাইলে প্রাইভেট গাড়িতেও যেতে পারেন যে কেউ। আপনি চাইলে ট্রেনে খুলনা, তারপর বাগেরহাটের রায়েন্দা হয়ে শরণখোলা রেঞ্জে আসতে পারেন।
সুন্দরবনে কোথায় থাকবেন?
রায়েন্দাতে রাত্রিযাপনের জন্য সরকারি ডাকবাংলো, আবাসিক হোটেল রূপসী রায়েন্দা, সুন্দরবন অবকাশ, পিংকিসহ বেসরকারি বেশ কয়েকটি রেস্ট হাউজ আছে।
এগুলোর মধ্যে কিছু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষও আছে। তাছাড়া রায়েন্দা থেকে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার বা লঞ্চে করে সীমিত ভাড়ায় সুন্দরবনের এসব এলাকা ভ্রমণ করা যায়।
সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ ডুবলার চর। প্রতি বছর কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত হয় রাস মেলা। মৎস্যজীবী সম্প্রদায় ও ভক্তরা এখানে মিলিত হয়ে উৎসব পালন করেন। অন্যদিকে পুটনী দ্বীপ নতুন করে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখানকার লাল কাঁকড়ার পদচারণা ও সমুদ্রবালির বিস্তৃতি পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
ঢাকা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণের সবচেয়ে জনপ্রিয় পথ হলো খুলনা বা মংলা হয়ে প্রবেশ। ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন বা লঞ্চে খুলনা যাওয়া যায়। এরপর ট্রলার বা লঞ্চে করে সুন্দরবনের বিভিন্ন স্পটে প্রবেশ করা যায়। চাইলে সাতক্ষীরার শ্যামনগর দিয়েও নৌপথে সুন্দরবনে যাওয়া সম্ভব। অনেক ট্যুর অপারেটর ঢাকা থেকে প্যাকেজ ট্যুর আয়োজন করে। যেখানে ৩ দিন ২ রাতের খরচ পড়ে প্রায় ৭-৯ হাজার টাকা।
বাংলাদেশের সুন্দরবন শুধু পর্যটনের কেন্দ্র নয় বরং উপকূলীয় মানুষের জন্য প্রাকৃতিক সুরক্ষার ঢাল। ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের সময় বন উপকূলের জীবন বাঁচায়। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও অবৈধ কার্যক্রম সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলেছে। পরিবেশবিদদের মতে, স্থানীয়দের বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত না করলে বন সংরক্ষণ কঠিন হয়ে যাবে।