নিজস্ব প্রতিবেদক // ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৯ সালে। এর পর আর নির্বাচন হয়নি। জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর শিক্ষার্থীদের মাঝে দাবি উঠেছে ডাকসু নির্বাচনের। ঢাবি ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোরও দাবি, দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের। তবে এর আগে অবশ্য-প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো করে নিতে হবে। অন্যথায় এটি ভালো কোনো ফল বয়ে আনবে না।
সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে সেটি বরং ২০১৯ সালের নির্বাচনেরই আরেকটি উদাহরণ সৃষ্টি করবে বলে মনে করছে ছাত্র সংগঠনগুলো। তারা বলছে, দেড় দশক ধরে ক্যাম্পাসে ভিন্নমতের কোনো স্থান ছিল না। জুলাই অভ্যুত্থানের পর এখন পরিবর্তিত পরিবেশে প্রশাসনের উচিত সকল অংশীজনকে সাথে নিয়ে ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা।
তবে নির্বাচনের আগে গঠনতান্ত্রিক সংস্কার প্রয়োজন। ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যেন সকল সংগঠন সমানভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে। ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে আলোচনাসাপেক্ষে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হবে এবং অগণতান্ত্রিক ধারাসমূহ বাতিল করতে হবে। সংগঠনগুলো এও বলছে যে, নির্বাচন যত বিলম্ব হবে, ক্যাম্পাসের স্থিতিশীলতা ও সুন্দর পরিবেশ ততই নষ্ট হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত প্রাধান্য পাওয়া উচিত বলে মনে করি। প্রশাসনের উচিত শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। যত দ্রুত সম্ভব যাবতীয় সংস্কার শেষ করে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের আয়োজন করা। এক্ষেত্রে প্রশাসনের দায়িত্ব, সব পক্ষকে নির্বাচনে নিয়ে আসা। শিক্ষার্থীদের চাওয়া অনুযায়ী দ্রুত একটি ডাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা হোক, বলেন তিনি।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাবি শাখা সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন বলেন, দেড় দশক ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য ক্যাম্পাসে ভিন্নমতের কোনো অবস্থান ছিল না। আমরা মনে করি, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবার জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে। একই সাথে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি নির্বাচন আয়োজন করে, তা হলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল তাকে স্বাগত জানাবে।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি এসএ ফরহাদ বলেন, ডাকসুর রোডম্যাপ ও নির্বাচন আমরাও চাই। তবে নির্বাচনের আগে ডাকসুর গঠনতন্ত্রের সংস্কার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমূল সংস্কার সম্ভব না হলেও নির্দিষ্ট কিছু সংস্কার অবশ্য প্রয়োজন। যেমন- উপাচার্যের একচ্ছত্র ক্ষমতা, ছাত্রবিষয়ক কিছু সুপারিশসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দু-একটা মিটিং ডেকে সংস্কার করা সম্ভব। সংস্কারের পর ফেব্রুয়ারির মধ্যেই আমরা ডাকসু নির্বাচন চাই। যত বিলম্ব হবে, ক্যাম্পাসের স্থিতিশীলতা ও সুন্দর পরিবেশ নষ্ট হবে। ডাকসু নির্বাচন হওয়া মানে ছাত্রনেতারা শিক্ষার্থীদের কাছে যেতে বাধ্য হবে। ডাকসু হওয়া মানে ছাত্রনেতারা লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে শিক্ষার্থীবান্ধব রাজনীতি করতে বাধ্য হবে। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব ডাকসু হওয়া প্রয়োজন। ডাকসু নির্বাচন একাডেমিক ক্যালেন্ডারে আবশ্যকীয় করে আইন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডাকসু বন্ধ থাকায় ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক ভিতের ওপর দাঁড় করানোর আকাক্সক্ষা প্রবল হয়েছে। এর অংশ হিসেবেই অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচন করতে হবে। ডাকসু নির্বাচনের আগে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে যেন সকল সংগঠন সমানভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারে। নির্বাচনের আগে ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে আলোচনাসাপেক্ষে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন করতে হবে এবং অগণতান্ত্রিক ধারাসমূহ বাতিল করতে হবে।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাগীব নাঈম বলেন, গঠনতন্ত্রের সংস্কার না করে কোনোভাবেই নির্বাচনের দিকে যাওয়া যাবে না। গঠনতান্ত্রিক সংস্কার ও গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস নিশ্চিত না করে নির্বাচন করলে আগের ডাকসুর উদাহরণের মতো হবে। কেউ এ রকম চাইলে তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বলা হচ্ছে, সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়। তেমনি ডাকসুর নির্বাচনের ক্ষেত্রে আগে সংস্কার, এর পর নির্বাচনের আয়োজন করা প্রয়োজন। এখনও সিন্ডিকেটে স্বৈরাচারের দোসররা আছে। এ ছাড়া আরও বেশকিছু ইস্যুতে সংস্কার প্রয়োজন। এই সংস্কার না করে কোনো গোষ্ঠীর চাপে নির্বাচনের আয়োজন করা হলে তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি দিলীপ রায় বলেন, গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার নেপথ্যের একটি লক্ষ্য ছিল, গণতান্ত্রিক রূপান্তর। গণতান্ত্রিক রূপান্তর করতে হলে সেটা শুধু জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সম্ভব না। রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রয়োজন। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি গণতান্ত্রিক যাত্রা করতে পারে। সেই জায়গা থেকে মনে হয়, দ্রুত এ নির্বাচন হওয়া দরকার। সেটা অবশ্যই গঠনতান্ত্রিক ত্রুটি-বিচ্যুতির সংস্কারের মধ্য দিয়ে।
এসব বিষয় জানতে ঢাবি উপার্চায অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা আমাদের সময়কে বলেন, ডাকসু নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গুরুত্বের সাথে ভাববে। গঠনতান্ত্রিক সংস্কারের লক্ষ্যে গঠনতন্ত্র পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছি। সেই কমিটি আমাদের রিপোর্ট দেবে। উক্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আমাদের পরবর্তী কর্মপন্থা গ্রহণ করা হবে।