নিজস্ব প্রতিবেদক // সরকারি কর্মকর্তা হয়ে কেউ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও অংশ নিতে নেওয়া যাবে না সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫(১) ধারায় এমন কথা বলা থাকলেও তার কোনো তোয়াক্কা করেননি শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা মুকিব মিয়া।
চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণ করেছেন তিনি। নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নানা কর্মসূচিতেও।
জানা গেছে, মুকিব মিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী। তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সোহাগ-নাজমুল কমিটির গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। মুকিব মিয়া বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ৩১তম ব্যাচের কর্মকর্তা।
লালমনিরহাটের পাটগ্রামের সরকারি কাজী আব্দুল গণি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হলেও তিনি গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লিফলেট বিতরণ করেন। শুধু তাই নয়, লিফলেট বিতরণের সেই ছবি ও এ সংক্রান্ত প্রকাশিত সংবাদ তিনি তার ফেসবুক ওয়ালেও পোস্ট করেছেন।
মুকিব মিয়ার ফেসবুক প্রোফাইল ঘুরে দেখা যায়, মুকিব মিয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সমর্থক। আওয়ামী লীগের লিফলেট বিতরণের নানা জায়গার ছবি তার ওয়ালে পোস্ট করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিনিয়তই তিনি আওয়ামী লীগের নানা কর্মসূচির ছবি পোস্ট করেন।
তার প্রোফাইলে আরো দেখা গেছে, গত ২৭ মার্চ প্রোফাইল ছবি হিসেবে আপলোড করা শেখ হাসিনার ছবিতে লেখা বিজয় আসবেই।
৫ আগস্টের পর ‘লোভে পাপ, পাপে ইউনূস’, ‘ইউনূস বাহিনীর নির্যাতন নাৎসি হিটলারকেও হার মানায়’, ‘ইউনূসের নাৎসি বাহিনীর ছোবল থেকে রেহাই পেল না শিক্ষার্থীরা’, ‘বাংলাদেশকে গৃহযুদ্ধে ঠেলে দিতে মব সংস্কৃতি চালু করেছে অবৈধ ইউনূস সরকারের উপদেষ্টারা। জাতিকে প্রস্তুত হবে।
অরাজকতা রুখতে হবে’, ‘বিয়ে করতে, প্রেম করতেও ট্যাক্স দিতে হবে ইউনূসকে। কারণ সে সুদি কারবারি’, ‘ইউনূস ঠেলা সামলা’, ‘জঙ্গি ইউনূসের দিন শেষ’সহ বিভিন্ন লেখা ফেসবুকে লিখেছেন মুকিব।
চাকরিবিধি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের নির্দেশনা অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীর সামাজিক মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করার সুযোগ না থাকলেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কড়া সমালোচনা করে লেখালেখি করেন মুকিব মিয়া।
জানা গেছে, এসব লেখাকে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার ৩(খ) ধারা অনুযায়ী আচরণ লঙ্ঘন উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে গত ২০ জানুয়ারি বিভাগীয় মামলা করা হয়।
এ ছাড়া কেন তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না, তা ১০ দিনের মধ্যে জানাতে নোটিশও দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি ব্যক্তিগত শুনানিতে ইচ্ছুক কি না, তাও জানতে চাওয়া হয়।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে টানা ১০ বছর তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরে (ডিআইএ) কর্মরত ছিলেন।
সে সময়ও তিনি নিয়মিত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। মুকিব মিয়া গত তিম মাসে একদিনও কলেজে যাননি। এ ছাড়া শিক্ষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গসংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।’ বিধিমালার এ ধারা লঙ্ঘনের শাস্তি চাকরিচ্যুতি।
গত ৬ অক্টোবর এই কর্মকর্তাকে নিরীক্ষা অধিদপ্তর থেকে হবিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করা হয়। সেখানে তিনি কাজে যোগ দিয়ে একদিন চাকরি করেন বলে জানিয়েছেন অধ্যক্ষ মো. হারুন মিয়া। পরে গত ২১ অক্টোবর তাকে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে জসমুদ্দিন কাজী আব্দুল গণি কলেজে বদলি করা হয়।
মুকিব মিয়ার ভাষ্য, লিফলেট বিতরণ করে তিনি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করেননি। উল্টো ড. ইউনূস সংবিধান লঙ্ঘন করছেন বলে দাবি করেন তিনি। ফলে কারণে তিনি প্রতিবাদ করেছেন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগও প্রতিবাদ করছে। তাই আওয়ামী লীগের লিফলেট আমার নেতৃত্বে বিতরণ করেছি। এতে চাকরিবিধি লঙ্ঘন হয়নি। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার নেতৃত্ব দিয়েছে, এ দলের লিফলেট বিতরণ করা আমার অধিকার।
চাকরিতে যোগ না দেওয়ার বিষয়ে মুকিব মিয়া বলেন, ছুটির আবেদন করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কলেজের অধ্যক্ষ মো. হাবিবুর রহমান বলেন, গত তিন মাসে একবারও কলেজে আসেননি মুকিব মিয়া। যোগদানের জন্য তিনি অনলাইনে আবেদন করেন। তার আবেদন গ্রহণ করা হয়।
তবে তিনি তার যোগদানের হার্ডকপি জমা দেননি। সম্প্রতি তিনি ৩ মাসের অসুস্থতাজনিত ছুটি চেয়ে আবেদন করেছেন। কিন্তু সঙ্গে চিকিৎসকের সুপারিশ, ব্যবস্থাপত্র, অসুস্থতার প্রমাণপত্র কিছুই দেননি। এরপর থেকে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।