স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনী সংস্কারের লক্ষ্যে গত ৫ মে ৩২২ পৃষ্ঠার বিশদ প্রস্তাব দিয়েছে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন। এতে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অরাজকতা চিহ্নিত করে সমাধানে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এর মধ্যে চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার বাধ্যবাধকতা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমসহ নানা মহলে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন চিকিৎসারা। ওষুধ কোম্পানির প্রতিষ্ঠানগুলোও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। ওষুধ উৎপাদক ও চিকিৎসকদের যুক্তি হচ্ছে, জেনেরিক নাম লিখলে এবং ওষুধের ব্র্যান্ডের নাম না লিখলে সবচেয়ে ক্ষতি হবে রোগী। আর সুবিধা নেবে নিম্নমানের ওষুধ কোম্পানি ও ওষুধের দোকানদাররা।
তবে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা মনে করছেন, এই সংস্কার বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া দরকার জরুরি। যেসব জায়গায় জটিলতা আছে তা চিহ্নিত করে নিরসনের কথাও বলেছেন তারা। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক নাম লেখার আলোচনাটা পুরনো। অভিযোগ আছে, ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ কোম্পানির ওষুধ লিখতে নানাভাবে প্রভাবিত করে থাকেন। ডাক্তারকে বিভিন্ন ধরনের গিফট দেওয়া, চেম্বার সাজিয়ে দেওয়া, বাসার আসবাবপত্র কিনে দেওয়া, বিদেশ ভ্রমণের খরচ দেওয়াসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সুনির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধ লিখতে বাধ্য করেন। আবার ডাক্তার এত সব সুবিধা নিয়ে তাদের কোম্পানির ওষুধ লিখছেন কি না সেটা যাছাই করার জন্য চেম্বারের বাইরে থেকে রোগীর প্রেসক্রিপশনের ছবি উঠান ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা। ফলে রোগীর সেবা থেকে অনেক ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলাই মুখ্য হয়ে ওঠে চিকিৎসকদের।
তবে দেশের সব চিকিৎসক এই অভিযোগে অভিযুক্ত নন। সংখ্যায় কম হলেও অনেকে পেশাদারত্বের বাইরে এসেও নিজ উদ্যোগে মানুষকে বিনামূল্যে সেবা দিয়ে দেওয়ার উদাহরণও আছে।
প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার দ্বিমত ও সম্ভবনার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান আমাদের সময়কে বলেন, ‘যেকোনো বিষয়ে কেউ দ্বিমত করতেই পারেন। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হলে তো টোটাল ওয়ার্ক-আউট করতে হবে। আমরা কোনভাবে এগোব, সেই বিবেচনায় কর্মসূচি নিতে হবে।’
বিষয়টি নিয়ে ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ গত ৬ মে তার নিজস্ব ফেসবুক আইডিতে একটি দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছেন। এতে বেশ কজন চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট এবং ওষুধ উপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্তরা কমেন্ট করে তার বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘… বাংলাদেশে জেনেরিক নামে ওষুধ প্রেসক্রাইব করার মধ্যেও অনেক সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশে যত ওষুধ কম্পানি রয়েছে সব কি একই গুণগতমান সম্পন্ন ওষুধ তৈরি করে? না, করে না। … জেনেরিক নামে ওষুধ লিখলে ওষুধ দোকানদারদের হাতে সোনার হরিণ তুলে দেওয়ার মতো অবস্থা হবে। তারা তখন নকল ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির নিম্নমানের সস্তা ওষুধ ক্রেতার কাছে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করার সুযোগ পেয়ে যাবে।’ তিনি লেখেন, জেনেরিক নামে ওষুধ লিখতে হলে ড্রাগ স্টোরের বিক্রেতারা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রোগী। অনেকে আরও অসুস্থ হবে, নতুবা মারা যাবে।
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমি মনে করি, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সংস্কার প্রয়োজন। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে যদি যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের আদলে গড়ে তোলা যায়, তবে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে এক বিপ্লব সাধিত হবে। কিন্তু সেদিকে সরকারের কোনো নজর নেই…।’ তিনি বলেন, উন্নত বিশ্বের বহু দেশে জেনেরিক ও ব্র্যান্ড নামে ওষুধ প্রেসক্রাইব করা হয়। কঠোর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ থাকায় ওই দেশগুলোতে সেখানে জেনেরিক বা ব্র্যান্ড নামে ওষুধ প্রেসক্রাইব করলে সমস্যা হয় না।
ডা. লিখন নামের একজনের একটি ফেসবুক পোস্ট অনেক চিকিৎসককে শেয়ার করতে দেখা গেছে। ওই পোস্টে তিনি বলেন, ‘আমি কখনো কোনো জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন করব না। আমার এমবিবিএস সার্টিফিকেট+বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশনের কোথায়ও উল্লেখ নেই আমাকে মেডিকেশন জেনেরিক নামে লিখতে হবে।’ এর কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, জেনেরিক নামে ওষুধ লিখলে কোম্পানিগুলো বেশি লাভের জন্য নিম্নমানের মেডিসিন দেবে, রোগীদের সাইড ইফেক্ট বেশি হবে, ফলে রোগীর অবস্থা অনেক খারাপ হবে। যেমনÑ মিটফোর্ড বা চকবাজারের আটা-ময়দার তৈরি সব কোম্পানির হুবহু নকল মেডিসিন পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, ‘আগে নিম্নমানের কোম্পানির মেডিসিন উৎপাদন বন্ধ করেন, নকল মেডিসিন আমদানি নিরুৎসাহিত করুন, তারপর জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন লেখার চিন্তা করব।’ তার এই পোস্টের কমেন্ট বক্সেও অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ওষুধ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. জাকির হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা বলেছি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জেনেরিক নামে বা ব্র্যান্ডের নামে লেখা হয়। একেক দেশে একেক সিস্টেম। যার যার দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সিদ্ধান্তগুলো নেয়। ওষুধ লেখার ক্ষেত্রে জেনেরিক হোক আর ব্র্যান্ড নাম হোক ডাক্তার রোগীর জন্য যে ওষুধটা প্রয়োজন সেটাই লেখেন।’ তিনি বলেন, সব ডাক্তারকে কোম্পানিগুলো উৎসাহিত করে তা কিন্তু না। প্রয়োজন হলে ডাক্তার ওষুধ পরিবর্তন করে দেন।
জাকির হোসেন বলেন, ডাক্তাররা ওষুধের জেনেরিক নাম লিখলে দোকানদার তার লাভের হিসাবটা দেখবে। যে ওষুধ বিক্রি করলে বেশি লাভ হবে তারা সেই ওষুধটাই রোগীকে দেবে। ওষুধের জাজমেন্ট করার দায়িত্ব ডাক্তারের চেয়ে নন- মেডিকেল মানুষের হাতে চলে যাবে। বাংলাদেশের মানুষের শিক্ষার হার, বোঝাপড়ার লেভেল দিয়ে তো আমেরিকার সঙ্গে তুলনা করলে হবে না। আমাদের দেশের মানুষের চিকিৎসার জ্ঞান এখনও সেভাবে তৈরি হয়নি। এমন বাস্তবতায় যদি জেনেরিক নাম লেখার ক্ষেত্রে ২৫ পার্সেন্টে চলে যাই ৫ বছর পর শতভাগ জেনেরিক নাম লেখার প্র্যাকটিসে চলে যাই তাহলে হবে না। আমরা সেই সক্ষমতা অর্জন করিনি।’
এমন বাস্তবতায় নিম্নমানের কোম্পানি লাইসেন্স থাকা উচিত না বলে মনে করেন অধ্যাপক একে আজাদ খান। তার ভাষ্য, ‘সাব স্ট্যান্ডার্ড ওষুধ বাজারে থাকা উচিত না। ওষুধ এমন একটা জিনিস, যা কেক বা শাড়ি কাপড়ের মতো কিছু নয়। সুতরাং এটা বাস্তবায়ন করতে হলে অনেক কিছু বিবেচনায় করেই করতে হবে।’
বাংলাদেশের বাস্তবতায় জেনেরিক নাম লেখা সম্ভব কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে একে আজাদ খান বলেন, ‘সম্ভব তো বটেই। এখন আমরা যদি সিদ্ধান্ত নেই সবাই করাপ্টেড হয়ে যাব, তাহলে তো সম্ভব না। আমাদের সাজেশন হলো- এই সেক্টর ঠিক করতে হলে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে তা নেওয়া দরকার। কাউকে তো বলা হচ্ছে না যে, এই মুহূর্তেই করতে হবে। বলা হয়েছে, প্রথমত কিছু জেনেরিক করুক। পরবর্তী সময়ে শতভাগে উন্নীত হওয়া।’ বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানি বা ওষুধের দোকানদারদের অদক্ষতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফার্মেসিও স্ট্যান্ডার্ড করতে হবে।