অন্তর্বর্তী সরকার যাতে মূল সংস্কার কাজ সম্পন্ন করতে পারে, সেজন্য ‘যে প্রয়োজনই হোক না কেন’ ইউনূস সরকারকে সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, যাতে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে একটি নির্বাচন হতে পারে। তিনি বলেন, “আমি তার (মুহাম্মদ ইউনূস) পাশে থাকব- যাই ঘটুক না কেন, যাতে তিনি লক্ষ্যে সফল হতে পারেন।”
গতকাল সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় নিজের কার্যালয়ে বসে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করার একটি রূপরেখার কথাও তার কথায় উঠে আসে।
বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের পথিকৃৎ মুহাম্মদ ইউনূস দেশের বিচার বিভাগ, পুলিশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, এর মাধ্যমে ১৭ কোটি মানুষের দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম হবে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সপ্তাহ ছয়েক আগে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয়া ওয়াকার-উজ-জামান সাক্ষাৎকারে বলেন, সংস্কারের মধ্য দিয়ে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্রে উত্তরণ’ ঘটা উচিত। তবে সেজন্য সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।
গত মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ‘খুব ভালো সম্পর্ক’ আছে জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, তিনি প্রতি সপ্তাহেই মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। অস্থির সময়ের পরে দেশকে স্থিতিশীল করতে সরকার যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে সামরিক বাহিনীর সমর্থন রয়েছে।
“আমি নিশ্চিত, আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি, তাহলে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই,” বলেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারে দাবিতে গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন একপর্যায়ে ব্যাপক সরকারবিরোধী অভ্যুত্থানে রূপ নেয। স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী এ আন্দোনে এক হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ গেছে।
রয়টার্স লিখেছে, আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল মহানগরী ঢাকার রাস্তায় শান্তি ফিরেছে, কিন্তু হাসিনা সরকারের নাটকীয় পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
এক লাখ ৯০ হাজার সদস্যের পুলিশ বাহিনী এখনো বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে; উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছে।
শাস্তি ও সংস্কার
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে জন্ম নেয় বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালে শেখ হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর দেশ সামরিক শাসনের অধীনে যায়। ১৯৯০ সালে এক গণঅভ্যুত্থানে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের পতন ঘটে, তাতে করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
রয়টার্স লিখেছে, ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী ফের অভ্যুত্থান ঘটায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন জানায়। হাসিনার ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত দুই বছর ওই সরকার দেশ চালিয়েছিল।
বর্তমান সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান রয়টার্সকে বলেছেন, তিনি যে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দেন, তা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করবে না। তিনি বলেন, “আমি এমন কিছু করব না যা আমার বাহিনীর জন্য ক্ষতিকর। আমি একজন পেশাদার সৈনিক। আমি আমার সেনাবাহিনীকে পেশাদার রাখতে চাই।”
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সরকারের নেয়া সংস্কার প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেনাবাহিনীও তার সদস্যদের অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে। এরইমধ্যে কয়েকজনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রিত সংস্থায় কাজ করার সময় কিছু সামরিক কর্মকর্তা ‘নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে’ জড়িয়ে থাকতে পারেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যদি কর্মরত কোনো সদস্য দোষী সাব্যস্ত হন, অবশ্যই আমি ব্যবস্থা নেব।”
২০০৯ সাল থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৬০০ জনের ‘গুম’ হওয়ার অভিযোগ তদন্তে হাই কোর্টের একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
রয়টার্স লিখেছে, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনাবাহিনীকে দীর্ঘ মেয়াদে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে রাখতে চান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি সৈন্য রয়েছে এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সেনা পাঠানো দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
সেনাপ্রধান বলেন, “এটি (রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীকে দূরে রাখা) কেবল তখনই ঘটতে পারে, যখন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার কিছুটা ভারসাম্য থাকে, যেখানে সশস্ত্র বাহিনীকে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখা যেতে পারে।”
রয়টার্স লিখেছে, বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আছে, যা সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। সেনাপ্রধান যে ব্যবস্থার কথা বলছেন তা বাস্তবায়ন করতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
সেনাপ্রধান বলেন, “সামগ্রিকভাবে সেনাবাহিনীকে কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। একজন সৈনিকের রাজনীতি করা উচিত নয়।