নিজম্ব প্রতিবেদক, বরিশাল:: ‘মোগো ছোডকালে গাঙে খেও (জাল) দিলেই ভ্যাদা (ভেদা) মাছ পাইতাম। ভ্যাদা মাছের মজা অইন্যরহম। এহন গাঙে নাই, কোলায় (ফসলের মাঠ) নাই, নদী-নালায় নাই ভ্যাদা।’ভেজা শরীরে কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব সুলতান মাতুব্বর। ঝালকাঠি সদর উপজেলার শতদশকাঠি গ্রামের বাসিন্দা তিনি। নালার মতো বয়ে যাওয়া খালে কিছুক্ষণ আগেই মাছ শিকারের চেষ্টা করেছেন। যা পেয়েছেন তা নিয়ে হতাশ।
সুলতান মাতুব্বর বলেন, দেশী মাছ এহন আর আগের মতন নাই। উটকাল, চ্যাং (টাকি), মাগুর, কৈ, হরপুডি (সরপুটি), হিং (শিং), ট্যাংরা, মলা, ঢেলা, চ্যালা, হউল (শোল), বোয়াল, আইড়, বাইম, খইলসা, ফলি, চিংড়ি, গজার, বাশপাতারি, বেলে, দারকিনা, তিত পুঁটি, চিতল, পোমা (পোয়া), বক থুরিনা (কাইক্কা), দগরি মাছ (চেউয়া) আরও কতরহোমের মাছ খাইছি জীবনে। হ্যা এহন আর নাই। এহনগো মানসে ব্য়লার খাইয়াই শান্তি।
একই কথা বলেন প্রতিবেশী নরেশ শীল। তিনিও মাছ শিকারে নেমেছিলেন। বলেন, ভাইগো গত হইয়া যাওয়া কতেক মাছ এহন বাজারে ওডে। কিন্তু স্বাদ নাই হেরহমের। কারণও আছে, হাডে-বাজারে যে কই, হিং, কোরাল পাওন যায় হেগুলা চাষের। ব্য়লাল মুরহার খাওন খাওয়াইয়া ডাঙ্গোর হরে। স্বাদও বিস্বাদ।
বরিশাল অঞ্চলে ভেদা নামে পরিচিত সুস্বাদু মাছটির প্রমিত নাম রয়না মাছ। এর আরেকটি জনপ্রিয় নাম হলো মেনি মাছ বা নন্দই। শুধু যে গ্রামের মৎস্য শিকারি সুলতান মাতুব্বর আর নরেশ শীল ভেদা মাছ বিলুপ্তির কথা বলছেন তেমন নয়, খোদ মৎস্য অধিদপ্তরও বলছে রয়নাসহ বেশ কয়েকটি মাছ বিলুপ্তির পথে। অথচ নদী ও জলাশয় প্রধান বরিশাল বিভাগে দেড় দশক আগেও ভেদা মাছের প্রাচুর্য ছিল ঈর্ষণীয়।
ভেদা মাছের সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি দেশীয় প্রজাতির মাছ উদ্বেগজনকহারে হারিয়ে যাচ্ছে। এই মাছগুলোর বিষয়ে কোনো গবেষণা, তথ্য এমনকি পর্যবেক্ষণও নেই মৎস্য অধিদপ্তরের। তবে দপ্তরটি জানিয়েছে, বরিশাল বিভাগ থেকে পাঁচটি মাছ বিলুপ্তির পথে রয়েছে। মাছগুলো হচ্ছে- রয়না, সরপুটি, বাইম, তারা বাইম ও পাবদা।
বরিশালের সবচেয়ে পোর্ট রোড পাইকারী মৎস অবতরণ কেন্দ্র, নথুল্লাবাদ কাচাবাজার, বাংলাবাজার, নতুনবাজার, রূপাতলী বাজার, তালতলী মাছের বাজার ঘুরে দেখা গেছে নদী, সাগর ও চাষের মাছে বাজার সয়লাব। দেশীয় প্রজাতির মাছ নেই বললেই চলে। এছাড়া বাবুগঞ্জ, বাকেরগঞ্জ, মুলাদী ও উজিরপুর উপজেলার কয়েকটি বাজারের মাছ ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ করলে তারা জানিয়েছেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ বাজারে খুব কম উঠছে। এর প্রধান কারণ খাল, বিল, ডোবায় মাছ নেই।
পোর্ট রোডের ব্যবসায়ী রুবেল বলেন, মাঝে মধ্যে কিছু পরিমাণের ভেদা মাছ বাজারে আসে। তাও পরিমাণে মাত্র এক দুই কেজি। গত বছর এক কেজি ভেদা মাছ এনেছিলেন চেংগুটিয়ার একজন। ৯০০ টাকায় বিক্রি করেছেন।
তালতলী বাজারের ব্যবসায়ী ফারুক মীর বলেন, সরপুটি, দেশী পাবদা, মাগুর, কৈ, শিং, মলা, ঢেলা, চ্যালা, বাইম, খইলসা, চিতল, কাইক্কা, চেউয়া মাছ এখন বাজারে আসে না বললেই চলে। আমরা শুধু ইলিশ, চাষের কোরাল, চাষের কই, শিং, মাগুর, পাঙাশ আর কার্প জাতীয় মাছ বিক্রি করি। এগুলো চাষ হয় তাই এগুলোই নির্দিষ্টভাবে বাজারে আসে। দেশীয় মাছ হারিয়ে গেছে বললেই হয়।
নতুনবাজারে কথা হয় ষাটোর্ধ্ব মকবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, দেশীয় মাছ আমাদের ঐতিহ্য। এই মাছ শুধু যে খেতে সুস্বাদু তা নয় বরং উন্মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া যায় বিধায় বিপুল অর্থ সাশ্রয় করে। আমার ছোট বেলায় দেখেছি প্রত্যেকের ঘরে মাছ ধরার জাল ছিল। যখন দেখতো রান্না করার কিছু নেই ঘরের পাশের নদী, খাল বা ডোবায় জাল ফেলে মাছ ধরতো। আমিও অনেক ধরেছি। উজিরপুরের ভরাকোটায় আমার বাড়ি। ওখানে এখনো নদী, খাল, জলাশয় জীবন্ত। কিন্তু দেশীয় মাছ নেই। আমরা এখন পাঙাশের জাতি। বাজারে গিয়ে দেখবেন বড় বড় পাঙাশ সাজায়ে রাখছে।
বরিশালে কেন কমছে দেশীয় প্রজাতির মাছ
গবেষণা বলছে, দেশে মোট উৎপাদিত মাছের ২৫ শতাংশ উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছ। নদী কমিশনের তথ্য মতে, দেশে মোট নদীর ১০০৮টি। যদিও পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, প্রবহমান নদী আছে ৯৩১টি। নাব্যতা হারানো নদীর সংখ্যা ৩০৮টি। এরমধ্যে ঢাকা বিভাগে ৮৫টি, রংপুর বিভাগে ৭১টি, রাজশাহী বিভাগে ১৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১টি, সিলেট বিভাগে ১০টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৬টি এবং খুলনা বিভাগে ৮৭টি নদী নাব্যতা হারিয়েছে। নাব্যতা হারানো নদীর তালিকায় বরিশাল বিভাগের নাম নেই। বরিশাল বিভাগের ছয়টি জেলার সবগুলো নদী এখন পর্যন্ত সচল থাকলেও এসব নদী থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে মাছের প্রাচুর্য। খাল, জলাশয়, বিলে দেখা মিলছে না মাছের।
এ বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. জামাল উদ্দিন বলেন, অতিরিক্ত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করায় দিনে দিনে দেশীয় প্রজাতির মাছ অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। দুই দশক আগেও আমরা দেখেছে দক্ষিণাঞ্চলের নদী, নালায় দেশীয় মাছের প্রাচুর্য। কিন্তু দুই দশকে এত বেশি কীটনাশক ব্যবহৃত হয়েছে ফসলের ক্ষেতে তার একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশীয় প্রজাতির মাছের জীববৈচিত্রে।
তিনি বলেন, দেশে প্রয়োজনের অনুকূলে প্রতি বছর যে পরিমাণে কীটনাশক আমদানী করা হয় অবৈধপথে তার কয়েকগুণ বেশি কীটনাশক আসছে। সেই কীটনাশকগুলো আমাদের জমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃষক না বুঝে তার ফসলের জন্য মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করলেও ক্ষতিটা হয়ে যাচ্ছে অন্যস্থানে। তাছাড়া শিল্প কারখানার দূষণ, নদী দূষণ, পানি দূষণ, অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন সক্ষম মাছ ও পোনা শিকার, নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহারের কারণে নদী ও জলাশয় প্রধান অঞ্চল হলেও বরিশাল বিভাগ থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ আমরা হারাতে বসেছি।
মৎস্য অধিদপ্তর নির্বিকার
মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ করতে সরকার ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর উল্লেখযোগ্য সফলতা থাকলেও বরিশাল বিভাগে দেশীয় প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি ঠেকাতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট পটুয়াখালী উপকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উপকেন্দ্র প্রধান ড. মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, আমরা বর্তমানে খাচায় বোয়াল মাছ চাষ ও সামুদ্রিক শৈবাল চাষ নিয়ে কাজ করছি। দেশীয় প্রজাতির মাছ কেন হারিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে আসলে আমাদের কোনো জানাশোনা নেই। মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট পটুয়াখালীর খেপুপাড়া উপকেন্দ্র ফ্রেশ ওয়াটার ফিস নিয়ে কাজ করছে না।
বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ নিয়ে আমরা শঙ্কিত। পর্যায়ক্রমে এই মাছগুলো কমে যাচ্ছে। এর কারণ বিল, নদী, খাল, পুকুর, জলাশয় কমে যাচ্ছে। এতে দেশীয় প্রজাতির কৈ, শিং, মাগুর, রয়না, সরপুটি, পাবদা, শৌল, টাকি অর্থাৎ অতীতে যে মাছগুলো প্রিয় ছিল সেগুলো দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। এরমধ্যে বিলুপ্তির পথে রয়না, সরপুটি, বাইম, তারা বাইম আর পাবদা মাছ।
এসব মাছের প্রজননস্থানগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বিশেষত পানি সেচে একেবারে শুকিয়ে মাছ শিকার ও চাষাবাদ করা, অবাধে কীটনাশক ব্যবহারে রেণু পোনা ধ্বংস হচ্ছে বিধায় বরিশাল অঞ্চলে দেশীয় প্রজাতির মাছ কমে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, মৎস্য দপ্তর থেকে দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ ও শামুক উন্নয়ন প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প বরিশাল, বরগুনা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর জেলায় চালু করা হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশীয় মাছ সংরক্ষণের চেষ্টা হচ্ছে। তবে কি পরিমাণে মাছ কমেছে, কি কি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে তার তথ্য বা পর্যালোচনা নেই বলে স্বীকার করেন এই কর্মকর্তা।