আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে সারা দেশে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা। যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে তাগিদ দেয়ার পাশাপাশি, তারা নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করছেন।
দলীয় নেতা ও সদস্যরা সামাজিক এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণের পাশাপাশি, স্থানীয় ইউনিটগুলোর পুনর্গঠনও করছেন। তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো দলের অবস্থান এবং নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করা।
বিএনপির নেতারা জানাচ্ছেন, গত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকা দলের নেতাদের সমমনা রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সহায়তার জন্য কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতাদের চিঠি দেয়া হয়েছে।
দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, নির্বাচনে বিজয় হলে ‘সমমনা দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন’ এবং ‘দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট’ গঠনের। এ লক্ষ্যে বিএনপি এখন দেশজুড়ে প্রস্তুতি ও কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
এবারের নির্বাচনি প্রস্তুতিতে বিশেষভাবে প্রাধান্য পাবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়া প্রার্থী এবং ছাত্রদল থেকে উঠে আসা নেতারা। এছাড়া, আন্দোলনে সক্রিয় সাবেক এমপিরাও দলের বিবেচনায় থাকার ইঙ্গিত পেয়েছেন।
দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচনের প্রস্তুতি সবসময়ই আমাদের ছিল এবং এটি থাকেও। তবে সময়ে সময়ে এর বিভিন্ন দিক আপডেট বা পরিবর্তন হয়। সেগুলো আমরা করছি।’
সাংগঠনিক যত প্রস্তুতি:
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, অনেকগুলো ফ্যাক্টর বিবেচনায় রেখে দলের কার্যক্রম এখন এগুচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দলের চেয়ারম্যান বলেছেন নির্বাচনে জিতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে অর্থাৎ জাতীয় সরকার করে দল পরিচালনা করা হবে। যেসব দল আন্তরিকভাবে বিএনপির সঙ্গে ছিল তারাও সেই সরকারে থাকবেন। ফলে নির্বাচনি প্রস্তুতিতেও এ বিষয়টিও নিঃসন্দেহে বিবেচনায় থাকবে। কোনো কোনো এলাকায় তারাও দলের বিবেচনায় থাকবেন।’
মূলত ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা হারানোর পর থেকেই দেশজুড়ে বিএনপির বেশিরভাগ কমিটি হয়েছে ঢাকা থেকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে দলের নেতারা মামলা ও হামলাসহ নানা কারণে এলাকায় অনিয়মিত ছিলেন কিংবা থাকতে পারেননি।
এ কারণে ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিএনপির অনুকূলে আসার পর থেকেই দেশজুড়ে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছে দলটির হাইকমান্ড। এরই মধ্যে মাগুরা ও কুষ্টিয়াসহ কয়েকটি জেলা কমিটি বাতিল করা হয়েছে।
প্রায় নয় বছর পর কমিটি হয়েছে বরগুনায়। বিলুপ্ত করা হয়েছে খুলনার আহবায়ক কমিটি। কাজ চলছে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার বিভিন্ন কমিটি নিয়ে।
দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘গত ১৫ বছরে আমরা কোনো এলাকায় সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারিনি। এখন প্রতিটি এলাকায় প্রতিটি ইউনিটিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করা হচ্ছে। এর মাধ্যমেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হবে দল।’
দলের নেতারা বলেন, বিএনপির তিন সহযোগী সংগঠন যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল সারা দেশে যৌথভাবে প্রতিটি জেলায় যৌথ কর্মিসভা করছে, যার মূল উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ নির্বাচনকে সামনে রেখে তারেক রহমানের নির্দেশনা প্রতিটি জেলায় পৌঁছে দেয়া।
তিনটি সংগঠনের শীর্ষ নেতারা জেলা পর্যায় সফর করে এসব সমাবেশগুলো সমন্বয় করছেন। এর ফলে মাঠ পর্যায়ে তরুণ নেতাকর্মীরা তাদের করণীয় সম্পর্কে বার্তা পাচ্ছেন বলে মনে করছেন দলের নেতারা।
নির্বাচনি প্রস্তুতি যেভাবে চলছে:
মূলত ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ও এমপিসহ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা, ২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রার্থীরা এবং নতুন করে আগ্রহী প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেছেন।
দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা রেজাউর রহমান বলেন, তার এলাকার বিএনপির সাবেক এমপি নির্বাচনি প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ব্যাপক জনসংযোগ শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছর আমাদের দলের সাবেক এমপি এলাকায় আসতে পারেননি। ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার অপরাধে আমাদের এলাকায় আওয়ামী লীগ কর্মীদের হামলার শিকার হতে হয়েছিল। এবার ৮ আগস্ট তিনি এলাকায় এসেছেন। বন্যা ও পূজার সময় নিজে এলাকায় থেকে কাজ করেছেন। তিনি থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে ছিল। পুরো এলাকায় জনসংযোগ ও দলীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন।’
সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, বিএনপি দলীয় সাবেক এমপি বা মন্ত্রীরা কেউই গত ১০ বছরে তাদের নিজ এলাকায় গিয়ে দলীয় বা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেননি।
তিনি বলেন, হাজার হাজার নেতাকর্মী মামলার শিকার হয়েছে। এখনো অনেকে জেলে। প্রতিটি এলাকায় নেতাদের মামলার জট থেকে বের করে আনার কাজ চলছে।
এছাড়া সাম্প্রতিক বন্যা ও পূজার সময় দলের সাবেক এমপি বা সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রিন্স বলেন, ‘আমাদের নেতারা যার যার এলাকায় ব্যাপক রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কর্মসূচিগুলোতে জনগণের পাশে থাকছেন। প্রতিটি এলাকায় প্রতিটি ইউনিট এতে সক্রিয় হয়েছে।’
কারা প্রাধান্য পাচ্ছেন:
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে দলের সাবেক এমপি বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে যারা দলের প্রার্থী ছিলেন তারা এবং বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল থেকে উঠে আসা নেতারা আগামী নির্বাচনে বেশি গুরুত্ব পাবেন।
সে কারণে নির্বাচনি এলাকাগুলো চষে বেড়াতে শুরু করেছেন তারা। কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক এমপিরা এখন নিজ নিজ এলাকায় কাজ করলেও গত ১০ বছরে যারা সক্রিয় ছিলেন না তারা এই নির্বাচনে কতটা বিবেচনায় আসবেন তা নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা আছে।
যুগ্ম মহাসচিব এমরান সালেহ প্রিন্স বলছেন ভবিষ্যতের জন্য দলীয় হাইকমান্ড প্রাধান্য দিচ্ছেন তাদের, যারা নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রেখে রাজপথে সক্রিয় ছিল। তবে যারা যৌক্তিক কারণে নিষ্ক্রিয় ছিলেন তারা বিবেচনায় আসবেন কি না সেটা দল আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবে।
তিনি বলেন, ‘এখন নেতাকর্মীদের বলা হয়েছে তৃণমূল কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে। তাদের সমস্যা দেখতে এবং জনগণের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ তৈরি করতে। দল দেখছে কারা দুঃসময়ে কাজ করেছে। অবশ্যই নির্বাচনের জন্য আত্মত্যাগ, পনের বছরের ভূমিকা, জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক দক্ষতা-এসব বিষয় বিবেচনায় আসবে।’