দেশে এখনো চলছে শীত মৌসুম। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে লোডশেডিংয়ের বিড়ম্বনা। গত সপ্তাহ থেকে দেশে কম-বেশি একশ মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শীত শেষে গরম শুরু হলে বিদ্যুতের চাহিদা যখন বাড়বে, তখন এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে মার্চ থেকেই দেশে শুরু হবে পবিত্র রমজান মাস। এই সময়টায় লোডশেডিং আরও তীব্র হতে পারে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছে। বিদ্যুতের বকেয়া বিল না পাওয়ায় উদ্যোক্তারা প্রাথমিক জ্বালানি কিনতে পারছে না। দিন দিন সরকারের কাছে বকেয়া বিলের পরিমাণ বাড়ছেই। অন্যদিকে, গ্যাসের সংকট তীব্র হচ্ছে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে উচ্চদামের ডিজেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালাতে হবে। তবে তাতে সরকারের ব্যয় ও লোকসান বাড়বে। এ ছাড়া লোডশেডিং হলে মাঠপর্যায়ে সেচেও ডিজেলচালিত সেচ পাম্পের খরচও বাড়বে। এ অবস্থায় ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর বিল পরিশোধ করা গেলে লোডশেডিং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। বছরে ৬ শতাংশ করে চাহিদা বাড়ার হিসাবে আসন্ন গ্রীষ্ম মৌসুমে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা দাঁড়াবে ১৮ হাজার মেগাওয়াট। ফলে আসন্ন গ্রীষ্মে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হলে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালানোর বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এজন্য সরকারের উচিত এসব কেন্দ্রে বকেয়া বিল সমঝোতার মাধ্যমে আংশিক পরিশোধ করে হলেও কেন্দ্রগুলো চালানোর ব্যবস্থা করা।
বর্তমানে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে ২৫ হাজার ৩৩৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক ১১ হাজার ৩৭২ মেগাওয়াট (৪৫ শতাংশ), ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৬ হাজার ৪৯২ মেগাওয়াট (২৬ শতাংশ), ডিজেলভিত্তিক ৮২৬ মেগাওয়াট (তিন শতাংশ), কয়লাভিত্তিক তিন হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট (১৩ শতাংশ), অনগ্রিড সৌরবিদ্যুৎ ৪৫৯ ও জলবিদ্যুৎ ২৩০ মেগাওয়াট (৩ শতাংশ) এবং বিদ্যুৎ আমদানি দুই হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট (১০ শতাংশ)। তবে এই উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা কখনোই ব্যবহার করা যায়নি। ফলে শীতের মধ্যেও গত মাসে দেশে লোডশেডিং হয়েছে। গত মাসে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং হয়েছে গত ২৮ জানুয়ারি সকাল ৯টায়, ১৯৩ মেগাওয়াট। এ ছাড়া গড়ে প্রতিদিন ৭০-৮০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শনিবার বন্ধের দিনে লোডশেডিং শুরু হয় সকাল ৮টা থেকে। এ সময় ১২ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। আর দুপুর ১টায় লোডশেডিং হয় ৫৪ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফয়জুল কবির খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় নিতে হবে। আমরা বিদ্যুৎ যে দামে কিনি, আর যে দামে বিক্রি করি, তাতে পার্থক্য রয়েছে। আমরা গড়ে বিদ্যুৎ বিক্রি করি ৮ টাকা ৯০ পয়সায়, আর কিনতে ১২-১৩ টাকা পড়ে। বেসরকারি খাতে উদ্যোক্তাদের বিল আমরা দিতে চাই। পিডিবি তো নিজেরা টাকা দিতে পারবে না। সরকারকে সাবসিডির ওপর নির্ভর করতে হয়। তার পরও আমরা চেষ্টা করছি সবদিক সমন্বয় করে পরিস্থিতি সামাল দিতে।’
একই কথা জানালেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘আসন্ন গ্রীষ্মকালে লোডশেডিং কমাতে আমরা চেষ্টা করছি। গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো পূর্ণ সক্ষমতায় চালানোর চেষ্টা করছি। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে বকেয়া বিল কিছু কিছু পরিশোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করি আসন্ন গ্রীষ্মে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে।’
বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) সভাপতি কে এম রেজাউল হাসনাত বলেন, ‘আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জ্বালানি তেল কিনতে এলসি খুলতে পুরো টাকা বা অধিকাংশ টাকা পরিশোধ করতে হয়। এটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা সরকারের কাছে বারবার বলছি, বকেয়া বিল কিছু কিছু করে হলেও সমন্বয় করতে।’
জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ‘গ্রীষ্মে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালাতেই হবে। এখন এর কোনো বিকল্প নেই। তবে এলএনজি আমদানি বাড়াতে পারলে কিছুটা স্বস্তি আসবে।’ তার মতে, ‘বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বকেয়া বিলের কিছু টাকা পরিশোধ করে সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। যেসব বিতর্কিত কোম্পানি রয়েছে, তাদের কেন্দ্রগুলো পিডিবি কিনে নিতে পারে। তবে এটা সরকারের পলিসিগত বিষয়।’
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছর বিদ্যুতের চাহিদার প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ ধরলে আগামী মার্চে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে ১৮ হাজার ২৩২ মেগাওয়াট। এই চাহিদা মেটাতে গ্যাসিভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৬ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, কয়লাভিত্তিকি কেন্দ্র থেকে ৫ হাজার ৫৫৮ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ৪ হাজার ১৪৯ মেগাওয়াট উৎপাদনের পাশাপাশি ২ হাজার ১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে হবে। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর সবই বেসরকারি খাতে। বকেয়া বিল না পাওয়ার কারণে এই উদ্যোক্তারা জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না। ফলে গ্রীষ্মে ফার্নেস অয়েল-চালিত কেন্দ্রগুলো চালানো নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস ও কয়লা সংকটের কারণে প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করাও অনিশ্চিত। দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গত বছরের ৩০ এপ্রিল ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিক্রি করে প্রতি ইউনিটে যে লোকসান হয়, তা পূরণ হয় সরকারের দেওয়া ভর্তুকির মাধ্যমে। পিডিবি বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ভর্তুকির টাকা ছাড় করলে বকেয়া শোধ করতে পারবে পিডিবি।
বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া বাড়ছেই: তিন বছর ধরে নিয়মিত বকেয়া অর্থ পরিশোধের চাপে আছে দেশের বিদ্যুৎ খাত। অর্থ সংকটে থাকায় বিল দিতে পারছে না পিডিবি। একই সঙ্গে চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় বিদেশি কোম্পানির বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত নভেম্বর পর্যন্ত পিডিবির বকেয়া ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাস বিল বকেয়া জমেছে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। গ্যাস বিল না দিলে পিডিবিকে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারবে না পেট্রোবাংলা। আর ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি পাবে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। বেসরকারি খাতে বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া ১০ হাজার কোটি টাকা। আর অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে বকেয়া ৫-৬ হাজার কোটি টাকা। বকেয়া শোধ না হলে জ্বালানি আমদানি করে উৎপাদন ধরে রাখতে পারবে না এসব কেন্দ্র। এ ছাড়া ভারতের আদানির বকেয়া ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় সক্ষমতার অর্ধেক সরবরাহ করছে আদানি। বকেয়া শোধে জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে তারা। এই কেন্দ্রের কয়লার বিল নিয়ে বিরোধ আছে। এটি এখনো সুরাহা হয়নি। তারা কয়লার বাড়তি দামে বিল জমা দিলেও পিডিবি বাজার দামে হিসাব করছে।
বেসরকারি উদ্যোক্তরা বলছেন, বিদ্যুতের বিল সাধারণত ৩০ দিনের মধ্যে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থাকলেও পিডিবি সেটা করছে না। এর ফলে আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল কিনতে পারছি না। আর ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন থেকে সর্বনিম্ন ৪০ দিন সময় প্রয়োজন হয়। এখন বিল পাওয়া না গেলে গ্রীষ্মে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো সম্ভব হবে না। এতে আসন্ন গ্রীষ্মে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হবে না, ফলে গ্রীষ্মে লোডশেডিং হতে পারে। ঘাটতি হতে পারে দুই থেতে তিন হাজার মেগাওয়াট।
গ্যাস সংকট প্রভাব ফেলবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে: গ্যাস সংকটে বর্তমানে সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে ৩০টির বেশি ছোট-বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক আড়াই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। আগামী মার্চের জন্য পিডিবি থেকে পেট্রোবাংলার কাছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। তবে পেট্রোবাংলা বলছে, চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ ১২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বিদ্যুতে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি সরবরাহ করা সম্ভব হবে না বলে পেট্রোবাংলার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। কারণ দেশীয় উৎপাদন দিন দিন কমছে। আর ডলার সংকটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী এলএনজি আমদানিও করা যাচ্ছে না। গত শনিবার বিদ্যুতে গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৭৪৯ মিলিয়র ঘনফুট। গ্যাস সংকটে গতকাল পর্যন্ত ৩৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ছিল।
সেচ খরচ বাড়বে, বাড়বে মূল্যস্ফীতি: দেশে আগামী মার্চ থেকে শুরু হচ্ছে সেচ মৌসুম। এই মৌসুমে সাধারণ কৃষকরা বিদ্যুৎচালিত সেচ পাম্প ব্যবহার করে। কিন্তু আসন্ন মৌসুমে বিদ্যুতের সংকট তৈরি হলে ডিজেলচালিত সেচপাম্প ব্যবহার করতে হবে। এতে করে ফসল উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে পণ্যের দামও বাড়বে, যা উস্কে দেবে মূল্যস্ফাীতিও।