শত বছর ধরে উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে মূল ভূ-খণ্ডে যাতায়াত করতো এখনকার মানুষ। কখনো কোমর পানি, কখনো হাঁটুপানি মাড়িয়ে ফিরতে হতো বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসীর। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের দুর্ভোগের অন্ত ছিল না। তবে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর এই দুর্ভোগের ইতি ঘটেছে ফেরি কপতাক্ষের চলাচলের মাধ্যমে।
রোববার (২০ এপ্রিল) ঘড়ির কাটা সকাল ৬টা ছুঁই ছুঁই। সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া-সন্দ্বীপ ফেরিঘাটের রাস্তায় ছোট-বড় যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী গাড়ির দীর্ঘ লাইন। পাশাপাশি প্রায় ৪ শতাধিক মানুষ অপেক্ষা করছে ফেরির জন্য। সকাল ৭টা ২০ মিনিটে সন্দ্বীপের গুপ্তাছড়া ঘাট থেকে বাঁশবাড়িয়া ঘাটে আসে ফেরি কপতাক্ষ। এরপর সন্দ্বীপ থেকে আসা গাড়ি ও যাত্রী নামার পর এখান থেকে গাড়ি ও যাত্রী নিয়ে সকাল ৮টা ১০ মিনিটে সন্দ্বীপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। রোববার হওয়ায় সন্দ্বীপে চাকরি করা লোকজনও কর্মস্থলে ছুটছেন।
আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক সন্দ্বীপের শীবেরহাট শাখার ব্যবস্থাপক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, দু’দিন বন্ধ থাকার পর আজ থেকে অফিস করার জন্য চট্টগ্রাম শহর থেকে সন্দ্বীপ যাচ্ছি। ফেরিতে আজ প্রথম উঠেছি। চালু হওয়ার পর কখনো উঠিনি। সকাল ৭টায় বাঁশবাড়িয়া ঘাট থেকে ছাড়ার কথা থাকলেও এক ঘণ্টা পরে ছেড়েছে। তারপরও এই সময়ে ফেরিতে করে যাতায়াত আমার কাছে নিরাপদ মনে হয়েছে। এই ফেরিটা যেহেতু সাগর দিয়ে চলাচল করবে, সেজন্য সাগরে চলাচলের উপযোগী ফেরি এখানে প্রয়োজন। আমি চাকরির সুবাদে প্রায় ১১ বছর যাবত সন্দ্বীপ যাওয়া-আসা করছি। এসময় দেখেছি মহিলা, শিশু ও রোগীদের অবর্ণনীয় কষ্ট।
তিনি আরও বলেন, আমি বিআইডাব্লিউটিএর কাছে অনুরোধ করবো এই রুটে যেন সাগর উপযোগী ফেরি চালু করে। আমরা যে ফেরি দিয়ে যাতায়াত করছি এটি নদী উপযোগী ফেরি। হয়ত ঝুঁকির কথা চিন্তা করে সামনে ফেরিটি বন্ধ করে দিতে পারে।
শেখ ফরিদ নামে ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ বলেন, পরিবারসহ শহরে থাকি। এখন আব্বা-আম্মার কবর জিয়ারত করতে হরিশপুর যাচ্ছি। এই ফেরি আমাদের জন্য বড় পাওয়া। যারা এই ফেরি চালু করছে তাদের জন্য দোয়া করছি।
ন্যাশনাল ব্যাংক সন্দ্বীপ শাখার ম্যানেজার মহিউদ্দিন বলেন, সন্দ্বীপ বঞ্চিত ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থায়। এই ফেরির কারণে এখানে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসছে। রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন হচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। জায়গা জমির দামও আগের থেকে বেড়ে গেছে। বিগত ১০ বছরে ঈদে মানুষ যে পরিমাণ যায়নি, এবার তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি মানুষ ঈদে বাড়ি গেছে শুধুমাত্র ফেরি চালু হওয়ায়। ব্যয় অনেক কমে গেছে। পণ্য পরিবহনেও অনেক খরচ কমেছে।
সরেজমিনে কপতাক্ষ ফেরিতে দেখা গেছে, যাত্রীর পাশাপাশি প্রায় ৩৫টি যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, লরি, পিকআপ, হাইস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও ২০টি মোটরসাইকেল বাঁশবাড়িয়া ঘাট থেকে ফেরি করে সন্দ্বীপ যাচ্ছে। ফেরিতে প্রায় ৪ হাজার যাত্রীর ধারণক্ষমতা রয়েছে। তবে সাগর উত্তাল হওয়ায় গত কিছুদিন ধরে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে ফেরিটি। বিশেষ করে ১৩ কিলোমিটার দূরত্বের এই পথে সাগরের বাঁশবাড়িয়া ঘাট থেকে কিছুদূর, মাঝপথে ও সন্দ্বীপ ঘাটের একটু আগে খুব বেশি ঢেউ দেখা যায়। এসময় অনেক যাত্রী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ফেরির মাস্টারও এই সময় ঝুঁকি নিয়ে চলাচলের বিষয়টি স্বীকার করেন। এই ফেরিতে মাস্টারসহ ২৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
এদিকে বাঁশবাড়িয়া ফেরিঘাটে ফেরিতে ওঠার রাস্তা জোয়ারের পানিতে প্রায় সময় ডুবে থাকে। এতে করে গাড়ি না উঠতে পারায় নির্দিষ্ট সময়ে ফেরি ছাড়তে পারে না। গুপ্তাছড়া ঘাটেও বৃষ্টির কারণে সড়ক কর্দমাক্ত হওয়ায় গাড়ি চলাচলে কিছুটা বেগ পেতে দেখা গেছে।
জানা গেছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিনই এই জনপদের প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার বাসিন্দা ২০ কিলোমিটার উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে জেলা শহর চট্টগ্রাম অথবা দেশের অন্য যেকোনো স্থানে যাতায়াত করেন। এসময় তাদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হতো। ফেরি চলাচলের মাধ্যমে ঘোচে সেই কষ্ট। গত ২৪ মার্চ সকাল সাড়ে ৮টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ঘাটে এই ফেরি সেবার উদ্বোধন করেন নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।
কপতাক্ষ ফেরির মাস্টার সাইফুল ইসলাম বলেন, ফেরি চালু হওয়ার পর থেকে সন্দ্বীপবাসীর দিন পরিবর্তন হয়েছে। যা এখানকার মানুষ কখনো কল্পনা করেনি। এই রুটে আমি প্রথম ফেরি চালানোর কারণে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। কারণ আমিও সন্দ্বীপের মানুষ। মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সাগরে লাল বোট, স্পিট বোট, কাঠের বোটের মাধ্যমে যাতায়াত করতো। আগে হিসাবে করে মালামাল নিত ব্যবসায়ীরা, এখন ফেরির কারণে একেবারে দোকানের সামনে মালামাল নিতে পারছে। আজকেও দুটি মরদেহবাহী গাড়ি ও একজন মুমূর্ষু রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে। অথচ আগে কেউ মারা গেলে বাড়ি নিতে অনেক কষ্ট করা লাগতো।
সাগরের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, এখন বর্ষা মৌসুম, নদী উত্তাল। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বড় গাড়ি বেশি ওঠাতে নিষেধ করে দিয়েছি। সন্দ্বীপ পারের চ্যানেল ব্লক হয়ে যাচ্ছে। নাব্য সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এই ফেরি চাঁদপুর-শরীয়তপুর রুটে চলাচল করতো। বৈরী আবহাওয়ার সময় ওখানেও বন্ধ রাখা হতো। সাগরে তো উত্তাল সময়ে চালানোর প্রশ্নই আসে না। কর্তৃপক্ষ বললে আমি আজকেই বন্ধ করে দেবো।
বিআইডব্লিউটিসির চট্টগ্রাম জোনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার গোপাল চন্দ্র মজুমদার বলেন, ১৫ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সাগর উত্তাল থাকে। এসময় সাগর পাড়ি দিয়ে এই ফেরি চলাচল সম্ভব নয়। এটির সাগর পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা নেই। এখন এই ফেরি চালালে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই এসময় ফেরি চলাচল বন্ধ রাখতে সরকারকে জানানো হয়েছে। সরকারের নির্দেশনা এলে যেকোনো সময় ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, সমুদ্রে চলাচল উপযোগী ফেরি নির্মাণের চিন্তা করছে সরকার। বিদেশ থেকে নকশা এনে তা বাংলাদেশেই নির্মাণ করা হবে। এই কোস্টাল ফেরি নির্মাণের জন্য এরইমধ্যে প্রকৌশলীদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।