নিজস্ব প্রতিবেদক // শীত এলেই খেজুরের গাছে ঝুলতো সারি সারি রসের হাড়ি। ভোর না হতেই রস সংগ্রহ করতে গাছিরা ছুটতেন রস সংগ্রহ করতে। সন্ধ্যা হলে সেই রস দিয়ে তৈরি হতো হরেক রকমের সুস্বাদু পিঠা। কিন্তু নগরায়নের এই যুগে এখন বিলুপ্তির পথে সুস্বাদু সেই খেজুরের রস। শীতের সকালে এখন আর খেজুরের রস সংগ্রহ করতে তেমন একটা দেখা যায় না গাছিদের।
গ্রামীণ কৃষকরা বলছেন, উন্নয়ন আর পরিবেশ দূষণের কবলে হারিয়ে গেছে খেজুর গাছ। যা আছে তা থেকে রস ঝরে না। আবার খেজুরের রস সংগ্রহে তেমন আগ্রহও নেই গাছিদের।
এবার শীত মৌসুমের শুরুতেই খেজুরের রস এবং গাছিদের সন্ধানে বরিশাল নগরীসহ সদর উপজেলার বিভিন্ন জনপদে ঘুরে বেরায় মতবাদ টিম। কিন্তু ৫৭ বর্গ কিলোমিটারের বরিশাল নগরীর কোথাও খোঁজ মেলেনি গাছি কিংবা খেজুরের রসের। এমনকি প্রস্তুতি নিতেও দেখা যায়নি কাউকে।
তবে বরিশাল নগরী থেকে দূরে সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের পূর্ব কর্নকাঠিতে খোঁজ মেলে একজন গাছির। এরই মধ্যে যিনি অন্তত ১০টির অধিক খেজুরের কাছ কেটেছেন রস সংগ্রহের জন্য।
কথা হয় পূর্ব কর্নকাঠি গ্রামের বাসিন্দা বাহার খানের সাথে। পেশায় তিনি একজন কৃষক। মতবাদকে তিনি জানিয়েছেন এই শীতে খেজুরের রস সংগ্রহে তার প্রস্তুতি এবং নানা অভিজ্ঞতার কথা।
বাহার খান জানান, একসময় তার বাবা গ্রামে ঘুরে ঘুরে খেজুরের রস কাটতেন। তার কাছ থেকেই শিখেছিলেন কিভাবে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে হয়। এরপর গত প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি গ্রামে ঘুরে ঘুরে খেজুরের রস সংগ্রহ করেন।
গাছি বাহার খান বলেন, একসময় শীতে আমি একাই প্রায় একশর মত খেজুর গাছ কাটতাম। কিন্তু এখন গাছের সংখ্যা কমে গেছে। এখন শুক্রবার পর্যন্ত ১৫টির মত গাছ কেটে প্রস্তুত করেছি। আরও ১৫-২০টি গাছ কাটার পরিকল্পনা রয়েছে। এগুলো থেকে এখনই রস ঝরবে না। আরও অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগবে।
এই গাছি বলেন, গাছগুলো সব গ্রামের মানুষের। তাদের কাটার মত লোক নেই বিধায় আমি কেটে দিচ্ছি। রাতের আঁধারে পোলাপান চুরি না করলে, আশা করছি ৩০-২৫টি গাছ থেকে দৈনিক ৬০ লিটার রস পাবো।
খেজুরের গাছ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে গাছি বাহার খান বলেন, একসময় গ্রামে মাটির রাস্তা ছিল। বড় বড় বাড়িঘর ছিল না। এখন সবখানেই পাকা রাস্তা আর বড় বড় বাড়ি হয়েছে। এজন্য অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া কয়েক জায়গায় ইটেরভাটা নির্মাণ করা হয়েছে। কালো ধোয়ায় গাছগুলো মরে যাচ্ছে। আর বেঁচে থাকলেও বেশিরভাগ গাছ থেকে রস ঝরে না। তাই রস সংগ্রহ নিয়ে এখন তেমন কারও মাথা ব্যথা নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু চরকাউয়া নয়, বরিশাল সদর উপজেলার চরবাড়িয়া, শায়েস্তাবাদ, চন্দ্রমোহন, চরমোনাই, টুঙ্গীবাড়িয়া ইউনিয়নে রস সংগ্রহে গাছিদের প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে। তবে বরিশাল নগরীর পার্শ্ববর্তী জাগুয়া, রায়াপাশা কড়াপুর এবং কাশিপুর ইউনিয়নে এমন দৃশ্য চোখে পড়েনি।
বরিশাল নগরীর পুরানপাড়া এলাকার বাসিন্দা জুয়েল রানা বলেন, কাঁচা রসের স্বাদ এখন তো ভুলেই গিয়েছি। খেজুরের রস বা গুড় দিয়ে পায়েস, দুধচিতই, পুলি পিঠা কতই না মজা ছিল। কিন্তু এখন সেই স্বাদ আর পাই না। কারণ এখন আর চাইলেই খেজুরের রস পাওয়া যায় না। পেলেও অনেক দূর থেকে দ্বিগুণের বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো খেজুরের রস বলে কিছু ছিল তাই জানবে না।
তবে খেজুর গাছ এবং রসের চাহিদা কমে যাওয়ার কিছু কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বরিশাল সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উত্তম ভৌমিক। তিনি বলেন, খেজুর গাছ কিছুটা কম আছে। তবে ইটভাটার কারণেই যে গাছ বিলীন হচ্ছে সেটা নিশ্চিত নই। খেজুর গাছ কমে যাওয়ার একটি প্রধান কারণ নগরায়ন এবং শিল্পায়ন। এসবের কারণে গাছ লাগানোর মত জায়গা থাকছে না। তাছাড়া নিপাহ ভাইরাসের একটা আতঙ্ক রয়েছে বরিশাল অঞ্চলের মানুষের মাঝে। ভাইরাস আতঙ্কে রসের চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে গাছির সংখ্যাও কমে গেছে। নতুন কেউ এই পেশায় আসছে না। তবে খেজুরের গুড় এখনো পাওয়া যাচ্ছে। আমরা খেজুর গাছ, তাল গাছ এবং সুপারি গাছ লাগানোর বিষয়ে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে থাকি। কারণ এগুলো বজ্রপাত প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে। এজন্য ইতিপূর্বে প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা কিছু গাছও লাগিয়েছি। যার সুফল ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে।