পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, অধিকাংশ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় ‘বড় ভাই’খ্যাত নেতায়ের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই ‘বড় ভাইদের’ কারণেই তাদের বাড়বাড়ন্ত। বিশেষ করে বখাটে কিশোর ও শিক্ষার্থীদের এই ‘গ্যাং কালচার’কে শক্তি ও বলপ্রয়োগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বড় ধরনের কোনো অপরাধমূলক কর্মকা-ে লিপ্ত হতে ভয় পায় না।
শুধু মারামারি বা খুনোখুনি নয়, এই কিশোর গ্যাংগুলোর সদস্যরা নিয়মিত মাদক সেবনের পাশাপাশি মাদক বেচাকেনায়ও জড়াচ্ছে। ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধ তাদের অনেকের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। মোটরসাইকেলের হর্ন বাজিয়ে উত্ত্যক্ত করা তাদের নতুন ধরন। পাড়া ও মহল্লা এবং স্কুল ও কলেজকে কেন্দ্র করে গ্যাং গড়ে উঠেছে। মহানগরের প্রতিটি স্কুল-কলেজে দুই বা ততোধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। জেলা ও মহানগরের এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা প্রায় তিন হাজার।
জানা গেছে, প্রথমে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাং গড়ে উঠলেও পরে এটি আধিপত্য বিস্তারের দলে পরিণত হয়। কেউ কেউ আবার এলাকার
উঠতি ত্রাস হিসেবেও পরিচিতি পাচ্ছে। কুমিল্লা মহানগরী ছাড়াও বিভিন্ন উপজেলায়ও তাদের আধিপত্য রয়েছে। গড়ে উঠছে তাদের রাজত্ব। তার মধ্যে লাকসাম, চান্দিনা, দাউদকান্দি, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা উল্লেখযোগ্য। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে ছুরি, চাপাতি, ড্যাগার, সুইচ গিয়ার চাকু, এন্টিকাটার, রামদা, হকিস্টিক ছাড়াও আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় নগরীর পাড়া-মহল্লার অনেকের কাছেই কিশোর গ্যাং আতঙ্কের নাম।
সর্বশেষ গত ১৯ আগস্ট কুমিল্লা শহরের নগর উদ্যানের পাশের সড়কে শাহাদাৎ হোসেন নামে এক কিশোরকে সংঘবদ্ধ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে। তারা ‘রতন গ্রুপ’ নামের একটি কিশোর গ্যাংয়েরর সদস্য বলে র্যাব জানিয়েছে।
এমনিভাবে গত তিন বছরে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে বলি হয়েছেন কুমিল্লা ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহজাদা ইসলাম, অজিতগুহ কলেজের শিক্ষার্থী শাহরীয়ার কবীর অন্তু, কুমিল্লা মডার্ন হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মোন্তাহিন ইসলাম মিরণ, মোগলটুলি এলাকার আজনাইন আদিল, জামতলার মিথুন ভুইয়া, দিশাবন্দ এলাকার শিক্ষার্থী সাজ্জাতুল ইসলাম। নগরীর নূরপুরে দশম শ্রেণির ছাত্রের হাতে খুন হন অটোরিকশা চালক। নওশাদ কবির মজুমদার ওরফে নাহিদ নামে কুমিল্লা জিলা স্কুলের দশম শ্রেণির এক ছাত্রকে গুরুতর জখম করা হয়। তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করার পর তার হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয় ‘আরজিএস’ নামের একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। তুচ্ছ ঘটনায় এ গ্যাংয়ের জাহিদ খান নামের আরেক কিশোর তার সঙ্গীদের নিয়ে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় ঈদগাহের পাশে এ ঘটনা ঘটায়।
চলতি বছরের গত ৪ মে টিকটক গ্রুপের মধ্যে পূর্ব বিরোধের জেরে শুভ নামে এক কিশোরকে বুকে ও পেটে ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয়। ছেলেটি জেলার আদর্শ সদর উপজেলার আড়াইওড়া গ্রামের ব্যবসায়ী জাকির হোসেনের ছেলে। গোমতী নদীর পালপাড়া ব্রিজ এলাকায় এ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে।
গত ১২ আগস্ট নগরীর ধর্মসাগর গেটসংলগ্ন পিজা কার্লজুন রেস্টুরেন্টে তিন-চারজন কিশোর খাবার খেয়ে চলে যাওয়ার সময় বিল চাইলে না দিয়ে উল্টো চাঁদা দাবি করে। অপারগতা জানালে গালমন্দের পর দোকানের আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়। তারা কাউন্টারে ঢুকে রেস্টুরেন্ট মালিক মো. শাহিদুজ্জামানকে আহত করে ক্যাশ থেকে টাকাও নিয়ে যায়। এ সময় কাস্টমাররা এগিয়ে এলে ছুরি দেখিয়ে তাদের ভয় দেখানো হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে কিশোর গ্যাংরে এক সদস্যকে আটক করে, বাকিরা পালিয়ে যায়। নিজেদের মধ্যে মারামারি করেও তাদের অনেক আহত হয়েছে।
গত ১৯ আগস্ট বিকালে কুমিল্লা শহরের নগর উদ্যানের পাশের ব্যস্ততম সড়কে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় নগরীর পুরান চৌধুরীপাড়া এলাকার শাহ আলম ভূঁইয়ার ছেলে শাহাদাৎ হোসেনকে (১৭)। এ ঘটনার পরদিন শনিবার রাতে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা হয়। ঘটনার পর র্যাব-১১, সিপিসি-২ কুমিল্লার একটি টিম ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে বিভিন্ন স্থান থেকে কিশোর গ্যাংয়ের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।
জানা গেছে, কুমিল্লায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাংগুলোর একটি হচ্ছে ‘ঈগল’। এই গ্রুপে আট শতাধিক সদস্য রয়েছে। নগরীর বিভিন্ন দেয়ালে এই গ্যাংয়ের লোগো ও নাম আঁকা রয়েছে। তাদের নামের ওপর কোনো ব্যানার-পোস্টার লাগালে আক্রমণ করে বসে। এই গ্রুপের স্লোগান ‘বার্থ টু ফ্লাই’। এর বেশিরভাগ সদস্যের বয়স ১৪-১৮ বছর। ‘জিএস গ্রুপ’ নামে আলোচনায় আছে আরেকটি গ্রুপ, যার আরেক নাম ‘রয়্যাল গ্যাং স্টার’। এতে সদস্য রয়েছে পাঁচ শতেরও বেশি। বেশি সদস্য সংখ্যার আরেকটি গ্যাং হচ্ছে ‘রতন গ্রুপ’। এ ছাড়া বিভিন্ন নামে গ্যাংগুলো গড়ে উঠেছে। প্রতিটি গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা ৪০ থেকে ৮০০ পর্যন্ত। মহানগরীতে ঈগল, জিএস ও রতন গ্রুপের সদস্যরা বেশি ভয়ঙ্কর।
কুমিল্লায় অন্য কিশোর গ্যাংগুলো মধ্যে ‘মডার্ন স্কুল ওয়ান’, মডার্ন স্কুল টু’, ‘রয়েল বেঙ্গল,’ ‘সিজলিন,’ ‘জেঅ্যান্ডজে,’ ‘বিগ ব্রাদার,’ ‘ডব্লিউআর’, ‘আরপিএস’, ‘টুইস্ট,’‘ ব্ল্যাক স্টার,’ ‘ডার্ক,’ ‘র্যাক্স,’ ‘এক্স,’ ‘এলআরএন,’ ‘এক্স সিএমএইচএস’ ‘সিএমসি,’ ‘রক স্টার,’ ‘ডিস্কো বয়েজ,’ ‘বস’ ইত্যাদি বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
এই গ্যাংগুলোর বেপরোয়া হয়ে ওঠার পেছনে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়াও আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের ঘাটতিরও অভিযোগ আছে। কখনো কখনো তাদের আটক করা হলেও আইনের ফাঁক গলে এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা বেরিয়ে আসে। তখন তারা আরও বেপরোয়া হয়ে যায়। তাই অনেকে মনে করেন, কিশোর আইন সংশোধন এখন সময়ের দাবি ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের নজরুল অ্যাভিনিউ, স্টেডিয়াম, ঈদগাহ, নগর উদ্যান, নিউ মার্কেট, এসবি প্লাজা, ভিক্টোরিয়া কলেজ রোড, তালপুকুরপাড়, শিক্ষা বোর্ড এলাকা, সদর হাসপাতাল রোড, রানীর দীঘির পাড়, ধর্মসাগর, মোগলটুলী, মদিনা মসজিদ রোড, রামমালা রোড, চর্থা, কোটবাড়ী, কালেক্টরিয়েট কলেজ, স্কুল গলি, রেলওয়ে স্টেশন এলাকা, রেসকোর্স ও ধর্মপুরে ভিক্টোরিয়া কলেজ রোড এলাকায় নিয়মিত আড্ডা দেয় বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা, যা চলে গভীর রাত পর্যন্ত। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হোয়াটসএ্যাপ ও ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ।
কুমিল্লা নাগরিক ফোরামের সভাপতি কামরুল আহসান বাবুল বলেন, অপরাধী হয়ে কেউ জন্মায় না। পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা মানুষকে অপরাধী করে তোলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা বেড়ে ওঠায় আধিপত্য বিস্তারে তাদের জন্য সহজ হয়ে ওঠে। শিশু-কিশোরদের অপরাধ থেকে মুক্ত রাখার জন্য পারিবারিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় জোর দিতে হবে।
কুমিল্লায় নবাগত পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান আমাদের সময়কে বলেন, কুমিল্লায় কিশোর অপরাধ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তবে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। নগরের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের টিম নিয়োজিত রাখব। প্রতিনিয়ত নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে টহল দেবে পুলিশ। সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা পেছন থেকে কিশোর গ্যাং পরিচালনা করছেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
Leave a Reply