নিজস্ব প্রতিবেদক // বরিশাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) বিরুদ্ধে সরকারের কয়েক কোটি টাকা অপচয় করে প্রতি বছর কম্পিউটার, এসি ও আসবাবপত্র কেনার অভিযোগ উঠেছে। ইনস্টিটিউটে জায়গা ও শিক্ষক না থাকা সত্ত্বেও চাহিদাপত্র দিয়ে ১৭টি এসি এবং ৩৭টি কম্পিউটারসহ ১৬ আইটেমের বিপুল সংখ্যক আসবাবপত্র কেনা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, লুটপাট করতেই এসব অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও জিনিসপত্র কেনা হয়েছে। প্রতি বছর এসব কিনে বছর শেষে বিক্রি করে সরকারি অর্থ লুটপাট করা হয় বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। এর সঙ্গে ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা জড়িত বলেও জানান শিক্ষার্থীরা।
ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা গেছে, ইনস্টিটিউটের একাডেমিক ভবনের সামনে ২ আগস্ট রাতে ঢাকা থেকে আসে কম্পিউটার ও আসবাবপত্রভর্তি ক্যাভার্ডভ্যান। এভাবে পরপর চার রাতে চার কাভার্ডভ্যানে বিভিন্ন ধরনের মালামাল আসে।
রাতেই মালামাল নামিয়ে ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন ক্লাস রুম থেকে শুরু করে খোলা জায়গায় রাখা হলে শিক্ষার্থীদের চোখে পড়ে। এরপর শিক্ষার্থীরা জানতে পারেন ওসব মালামাল ইনস্টিটিউটে ব্যবহারের জন্য কেনা হয়েছে। তবে যেসব মালামাল কেনা হয়েছে, তা স্থাপন করতে হলে আগেরগুলো সরাতে হবে। কারণ ইনস্টিটিউট ভবন ও ক্লাস রুমে নতুন মালামাল রাখার জায়গা নেই।
মালামালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১৭টি এসি, ৩০টি কম্পিউটার, সাতটি ল্যাপটপ, ৫০টি আলনা, বিভিন্ন ধরনের ১৯০টি চেয়ার, ৩০টি কম্পিউটার টেবিল, ১০টি ডাইনিং টেবিল, ছয়টি ল্যাবরেটরি রেক, ৮০টি রিডিং টেবিল, দুটি সোফা, ৮০টি খাট ও ২০টি ছোট টেবিল।
ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকেই শিক্ষক সংকট। তিন-চার জন শিক্ষক দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু যারাই দায়িত্বে থাকছেন তাদের নজর থাকে লুটপাটের দিকে। শিক্ষার্থীদের বিষয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। যেসব মালামাল কেনা হয়েছে, এসবের প্রয়োজন নেই। যা আছে সেগুলোও ব্যবহার করা হয় না। কিছু অসৎ মানুষের জন্য সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘১৭টি এসি এসেছে। অথচ এসি বসানোর কোনও কক্ষ নেই। তাহলে অযথা কোটি টাকা খরচ করে এসি এনে সরকারের খরচ বাড়ানোর কী দরকার ছিল। এছাড়া আগের কেনা ৫০টি কম্পিউটার ল্যাবে পড়ে আছে।
তার মধ্যে যেগুলোর সমস্যা ছিল, সেগুলো সচল করে চালানো যেতো। এখন ল্যাবে গিয়ে দেখা যাবে, আগের কম্পিউটারগুলো হাওয়া হয়ে গেছে। সেখানে নতুন কম্পিউটার বসানোর প্রক্রিয়া চলছে। যেখানে কম্পিউটারের শিক্ষক নেই। সেখানে ৩০টি কম্পিউটার এবং সাতটি ল্যাপটপ আনা হলো কেন?’
ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী ওবায়দুর রহমান বলেন, ‘ইনস্টিটিউটে খাটের কোনও প্রয়োজন নেই। আবাসিক হলের প্রতিটি কক্ষের খাট ভালো আছে। এসব মালামাল আনা হয়েছে শুধুমাত্র লুটপাট করার জন্য। প্রতি বছর এভাবে মালামাল এনে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও আনা হয়েছে। তবে এ বছরের ক্রয়-বাণিজ্য বেশি হওয়ায় বিষয়টি সবার চোখে পড়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শিক্ষার্থী জানান, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনও কথা বললে পরীক্ষায় নম্বর তো দেবেনই না, উল্টো ফেল করিয়ে দেবেন। এজন্য সংবাদে তাদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, অধ্যক্ষসহ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক পাঁচ জন। কম্পিউটার শিক্ষক নেই। শিক্ষার্থী রয়েছেন এক হাজার ২০০-এর বেশি। বেশিরভাই অতিথি শিক্ষক। তাদের সম্মানী দিয়ে আনা হয়। এভাবে বছরের পর বছর চললেও এই সংকট কাটিয়ে উঠার বিষয়ে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
তবে আর্থিক খাত সচল রাখতে তারা মরিয়া। এ বছর প্রতিষ্ঠানের জন্য কোটি কোটি টাকার মালামাল কেনা হয়েছে। ওসব মালামাল আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র অধ্যক্ষের যোগসাজশে লুটপাট করতে এসব মালামাল কেনা হয়েছে। এই কাজে শিক্ষকরাও জড়িত রয়েছেন।’
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘ব্যবহারিক ক্লাস করার মতো ল্যাবরেটরিতে কোনও মালামাল নেই। অথচ তা আনা হয়নি। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে অযথা এসি বসানোর প্রক্রিয়া চলছে। একইভাবে কম্পিউটার শিক্ষক না থাকায় হাতেকলমে কম্পিউটার ধরা হয়নি। আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম ক্লাস রুমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
আগের কেনা ৫০টি কম্পিউটার পড়ে আছে। সেগুলোর অবস্থা কেমন তা আমরা জানি না। এখন নতুন করে যে ৩৭টি কম্পিউটার আনা হয়েছে, সেগুলো কোথায় স্থাপন করা হবে। এক বছর গেলেই ওসব মালামাল গায়েব হয়ে যাবে। আবার শুরু হবে ক্রয়-বাণিজ্য।’
শিক্ষার্থীদের দাবি, প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই এ পর্যন্ত যেসব মালামাল কেনা করা হয়েছে, তার ব্যবহার নিশ্চিত এবং ওসব মালামালের তালিকা অনুযায়ী তদন্ত করলেই লুটপাটের রহস্য বেরিয়ে আসবে। কলেজের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ওসব মালামালের গুণগত মান যাচাই এবং পরিমাণ নির্ধারণে সার্ভে কমিটি গঠন করতে হয়। কিন্তু অধ্যক্ষ এ ধরনের কোনও কমিটি গঠন করেননি। অধ্যক্ষ এবং হিসাবরক্ষক মো. জুয়েলের যোগসাজশে এসব মালামাল কেনা হয়েছে। যারা এর বিরোধিতা করেছেন তাদেরকে নগদ অর্থ দিয়ে দমিয়ে রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশালের সভাপতি শাহ সাজেদা বলেন, ‘যেসব মালামালের প্রয়োজন নেই তাও কেনা হয়েছে। এটা স্পষ্টভাবে লুটপাট করার জন্য কেনা হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট দফতরকে তদন্ত সাপেক্ষে এই ক্রয়-বাণিজ্যের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
বরিশাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির অধ্যক্ষ ডা. মানুষ কুন্ডু বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। চাহিদাপত্র অনুুযায়ী মালামাল পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর।’ ১৭টি এসি কোথায় লাগাবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ইনস্টিটিউটের চার-পাঁচটি কক্ষে লাগাবো।’ বাকিগুলো কোথায় বসানো হবে জানতে চাইলে তিনি তা বলতে পারেননি।
একইভাবে যেখানে শিক্ষক নেই, ৩৭টি কম্পিউটার কোন কাজে ব্যবহার করা হবে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ বলেন, ‘আগের কম্পিউটারগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নতুন কম্পিউটার কেনা হয়েছে। প্রয়োজন আছে বলেই এসব কম্পিউটার আনা হয়েছে।’ এসব মালামালের চাহিদাপত্র দেখতে চাইলে দেখাতে পারেননি অধ্যক্ষ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এক বছর আগে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি। কোথায় রেখেছি তা মনে নেই।’
মালামালের গুণগত মান যাচাই এবং পরিমাণ নির্ধারণে কোনও কমিটি গঠন করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের অধ্যক্ষ বলেন, ‘না, এমন কোনও কমিটি গঠন করা হয়নি।’ কেন করেননি জানতে চাইলে তিনি তার জবাব দেননি।
কত টাকার মালামাল এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সঠিকভাবে বলতে পারবো না। সম্ভবত তিন কোটি টাকার মালামাল এসেছে। যেভাবে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি, সেভাবে মালামাল পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতর।’
Leave a Reply